Saturday, 28 March 2020

একটি নিখুঁত দুর্ঘটনা


একটি  নিখুঁত দুর্ঘটনা 

তখন আমার আস্তানা ছিল এক জঙ্গলের ভিতর নদীর ধারের বাংলো। কুয়াশায় মোড়া এক অমাবস‍্যার রাত। চার দিক নিঃশব্দ। কোথাও কোনো লোকজন নেই। এই জায়গা টাই এরকম। দিন পনেরো মতো হয় ওখানে গিয়েছি। কোলকাতা টা বড্ড এক ঘেয়ে লাগছিল। আমার ছিল কাঠের ব‍্যাবসা। মুলত কাঠ যোগানোর চাহিদা আর নিজের এক ঘেয়েমী কাটাতেই সেখানে যাওয়া। ওখানে লোকজন কম থাকলেও কিছু দূরে আরেকটি বাড়ি ছিল। ভদ্রলোকের নাম নবীন বাগচী। তিনি ছিলেন সেখানকার জঙ্গলের দায়িত্ব প্রাপ্ত আধিকারিক। খুব ভালো লোক ছিলেন তিনি। তিনি আর তার স্ত্রী থাকেন। গাছ কাটার অনুমতি নিতে গিয়েছিলাম তার কাছে অফিসে। দুটির বেশি গাছ কাটার অনুমতি পাইনি। কিন্তু শর্তও ছিল । দুটো গাছ কাটলে চারটে চারা লাগাতে হবে। তাতেই রাজি। কিন্তু সেই সম্পর্ক পৌছল বাড়ি অবধি। তার স্ত্রীর সঙ্গেও আলাপ হয়েছিল। বেশ ভালো মহিলা। সহজেই মিশে গেছিল আমার সাথে।

********

রোজ রাতে খেয়ে উঠে একটু জঙ্গলে বেড়িয়ে আসা আমার অভ‍্যেস হয়ে উঠেছিল। সেই রাতেও বেরিয়েছিলাম একটু। এসে তৈরী বিছানায় শুয়ে আরাম করে ঘুম। ঘুম টাও হয়েছিল জোর। কাজের ছেলেটি মাধব এসে ডাকায় ঘুম টা ভাঙ্গল। সেই হাপাতে হাপাতে খবর দিল নদীর ধারে একটা লাশ পাওয়া গেছে। আর সেই লাশ নবীন বাগচীর। কিছুক্ষণ নিষ্পলক তাকিয়ে থাকলাম মাধবের দিকে যেন অন্য কোনো ভাষায় কথা গুলো বলল। সম্বিত ফিরে আসতেই এক লাফে উঠে জামা টা গায়ে চাপিয়ে ছুটলাম। গিয়ে দেখলাম পুলিশে ছেয়ে গেছে জায়গাটা। সবাইকে কাটিয়ে সামনে গিয়ে দেখি এক বিভৎস দৃশ্য। ভদ্রলোক রাতে বোধহয় এসেছিলেন নদীর ধারে কোনো কাজে। আর সেখানেই পা পিছলে পড়ে গিয়ে মাথাটা পুরো থেতলে গেছে। দাঁড়িয়ে থাকতে পারলাম না আর বেশিক্ষণ। বেরিয়ে এলাম। শুরু হল পুলিশী তদন্ত। আমি পারিবারিক বন্ধু বলে আমাকেও জিঙ্গাসা করল পুলিশ। যা জানি সবই বললাম। রাতে আমি বেরিয়েছিলাম এবং তার সাথে যে আমার দেখা হয়নি সে কথাও জানালাম পুলিশ কে। ঘরে ফিরে এলাম। বোধহয় অ‍্যাকসিডেন্ট কেস। হাঃ। মনটা খারাপ হয়ে গেল।

********

"এই দাদা দাদা শোননা। আমার বান্ধবী অমৃতা। ওকে একটু ওর বাড়ি দিয়ে আসবি? রাত হয়ে গেছে, একা যেতে ভয় পাচ্ছে। যা না দাদা একটু দিয়ে আয়।"
আমার বোন অন্তরার সেদিন ছিল জন্মদিন। ওর কয়েকজন বান্ধবী এসেছিল। সবাই চলে গেলেও ও কোনো একটা কাজে আটকে গেছিল। তাই রাত হয়ে গেছিল। অগত‍্যা অনিচ্ছা শর্তেও গেলাম। বাইকের পিছনে বসল অমৃতা। দুজন দুজনকে চিনি না। কোনো কথাও হল না দুজনের। বাইক থেকে নেমে লজ্জা অবনত মুখে সামনে এসে ধন্যবাদ জানিয়ে বাড়ির ভিতরে চলে গেল। কিন্তু কি যেন ছিল সেই সেই ধন্যবাদে। আমি কোনো দিন এসব নিয়ে ভাবিনি। ব‍্যাবসা নিয়েই থাকতাম। কিন্তু...
আস্তে আস্তে কখন যেন সেই পরিচয়  টা গভীর হয়ে ভালোবাসার সম্পর্কে দাড়ায়। চলছিল বেশ দিন গুলো।  বোনও জানত সব। খুশিও ছিল। কিন্তু হঠাৎ একদিন কাদো কাদো মুখে অমৃতা এসে বলল "বিয়ে করবে আমায়?"
এই কথাটার জন‍্য তখনই ঠিক প্রস্তুত ছিলাম না। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলাম মুখের দিকে। ধীরে ধীরে মাথা নিচু করে বলল "আমার বিয়ে ঠিক করেছে বাড়ি থেকে। কিন্তু তুমি যদি এখন রাজি থাকো তাহলে তোমার কথা বলতে পারি বাড়িতে।" কিন্তু আমি সেদিন রাজি হতে পারিনি। আমার মনে হচ্ছিলো নিজের ব‍্যাবসা দাড় করাতে আরও সময় লাগবে। কারো দায়িত্ব নাওয়া মুখের কথা নয়। চলে গিয়েছিল সেই দিন ও। আমিও আটকাতে পারিনি।
এক দিন দেখলাম দেখলাম বোন সেজে নিয়ে বেরোচ্ছে। সামনে এসে মুখ নিচু করে বলল আজ অমৃতার বিয়ে। তুই তো আর.... মুখে কিছু বললাম না। চুপচাপ ঘরে খিল দিলাম ।

******

এর বছর খানেক পর বোনের বিয়ে ঠিক হল। অমৃতা এসছে বোনের সঙ্গে দেখা করতে। আমি দোকান থেকে কোনো দরকারে বাড়ি এসেছিলাম। গলার আওয়াজ পেয়ে দরজার পাশে এসে দাড়ালাম। আড় চোখে দেখলাম ওকে। বোনের সাথে হাসছে গল্প করছে কিন্তু সেই উচ্ছলতাটা কোথায় যেন হারিয়ে গেছে।
রাতে খাওয়া সেরে বোন ঘরে এল। " জানিস দাদা আজ অমৃতা এসেছিল। ওরা এখন উড়িষ্যার কোনো এক বনের কাছে থাকে। ওর বর ওই বনের দায়িত্বপ্রাপ্ত আধিকারিক। ওর এখন সব আছে। কিন্তু কেন জানিনা ওকে একটু বিমর্ষ লাগল। সেই খুশি খুশি ভাবটা যেন কোথায় হারিয়ে গেছে।"
আমি ওর দিকে তাকালাম। বুকের মাঝে কেমন একটা চিনচিন করছে। হঠাৎ বোন নিজের থেকেই বলল " ওর বরের নাম নবীন বাগচী।"

********

ওখানে যাওয়ার পর নবীন বাগচীর সাথে পরিচয় হল। আর সেই পরিচয় যাতে ঘর অবধি পৌছায় তাই বেশি বেশি যাতায়াত শুরু করলাম। একদিন সত্যি আমায় আমন্ত্রণ জানাল তার বাড়িতে। গেলাম। স্ত্রী এল আপ‍্যায়ন জানাতে। সেই চেনা মুখ। সেই চেনা কন্ঠস্বর। শুধু হাসিটাই বদলেছে। প্রাণহীন নিস্তেজ হাসি। আমার তখন মুখ ভর্তি দাড়ির জঙ্গল। মোটা গোফ। বড় বড় চুল। মোটা রিমের কালো ফ্রেম। তখন আমায় চেনা বেশ শক্ত। চা নিয়ে সামনে এসে দাড়াল। চা টা যখন সামনের টেবিলে রাখতে এল দেখলাম মোটা কালশিটে দাগ হাতের পিছনে। আর নবীন বাবুর ওর ওপর তীক্ষ্ণ বিতৃষ্ণ নজর ছোখ এড়াল না। এরপর  রাতের দিকে মাঝে  মাঝেই ওই বাড়ির দিকে যেতাম আর শুনতে পেতাম নবীন বাবুর কর্কশ মদ‍্যপ চিৎকার আর তার স্ত্রীর আর্তনাদ  ই দিন রাতেই ঠিক করলাম একে রাখা যাবে না। রোজ রাতে নদীর ধারে বেড়াতে যেতাম। সেই রাতেও গিয়েছিলাম। কিন্তু দিনের বেলায় কিছু কাজ সেরে রেখেছিলাম। প্রথমে মাঝ রাতে নদীর ওপারে একটা গাছ কিছু টা কেটে রেখে এসেছিলাম। দিনের বেলা নবীন বাবু কে গিয়ে বললাম " রাতে চোরা শিকারীরা গাছ কাটছে নদীর ওপারে। আপনি  রাতে নিজেই একবার দেখুন তারপর নাহয় পুলিশকে খবর দেবেন। " এত তাড়াতাড়ি রাজী হবেন ভাবিনি। ফিরে এলাম নদীর কাছে যেখানে গাছ টা কেটে রেখেছিলাম তার উল্টো দিকে নদীর এপারে একটাই বড় পাথর। তার ওপরে বিছিয়ে দিলাম একটা দড়ির ফাঁদ। আর ওই পাথরের ওপর আরেকটি পাথর চাপিয়ে দিলাম। রাতে খাওয়া আগেই সেরে বেরিয়ে গেলাম। গিয়ে বসলাম পাথর টার পিছনে। কিছু পরেই দেখতে পেলাম নবীন বাবু আসছেন ।  কাছে আসতে মদের গন্ধ নাকে এল। এসে ঐ পাথরের উপর। আমিও সুযোগ বুঝে দড়িতে দিলাম এক টান। সাথে সাথে চিৎ হয়ে পড়ল পাথরের ওপর। আমি উপরের পাথরটা দিলাম মাথা লক্ষ্য করে ঠেলে। থেতলে গেল মাথাটা। পা থেকে দড়ি খুলে জলে পা টা নামিয়ে ঘরে ফিরে এলাম। পুলিশ এল। তদন্ত হল। দুর্ঘটনায় মৃত্যু।

********
আজ আমি বিবাহিত। আমার স্ত্রীর নাম? অমৃতা আজও জানে তার আগের স্বামী দুর্ঘটনায় মারা গেছে। আর বতর্মান স্বামী এখন তার সব। এখন সব সময় তার চেনা হাসি ঠোঁটে লেগে থাকে। আরও যেন উচ্ছল।


যুযুৎসু

মহাভারতের অজানা চরিত্র যুযুৎসু মহাভারত বিষয়ে আমরা অনেক কিছু জানলেও অনেক চরিত্র এখনো অনেকের অজ্ঞাত। কথায় আছে যা নেই মহাভারতে তা নেই ভূ-ভার...