মাঝে মাঝে পৃথিবী টা খুব একা লাগে। মনে হয় কেউ নেই, কিচ্ছু নেই। আমি একা কোনো নিরালা দ্বীপে বসে আছি। সেখানে শুধু আমি একা। কোনো মানুষ নেই। পাখিরাও যেন এই পথ মারাতে ভুলে গেছে। আজ আমার স্বামী অতি ব্যস্ত সফল একজন মানুষ। রাতের বিছানা ছাড়া তাকে আর পাওয়া যায় না। আমার মেয়ে সম্প্রতি সে কলেজে উঠেছে। তার আর সময় কোথায় মায়ের সঙ্গে দুটো কথা বলার। মুখ টা ভাল করে দেখতে বোধয় appointment নিতে হবে। আর আছে tv যে আমার সময়ের সাথী। কি সব যেন দেখায় কার দুটো তিনটে বিয়ে। কেউ কালো বলে সংসারে স্থান নেই। আরো কিসব। আর আছে প্রতি হিংসা। সেটা খুন হলেও কোনো অসুবিধা নেই। মানুষের মনে যে কি থাকে কে জানে। আর এই writer গুলোর মাথায় যে কি আছে!!
এখন সন্ধ্যা ৭টা। tv তে একটা কালো মেয়ের গল্প দেখাচ্ছে, সে নাকি আবার গায়িকা। তাই নিয়ে বাড়িতে খুব অশান্তি। নায়কের নাকি গায়িকা তে ফাঁড়া। কি অবস্থা। যাক যা হচ্ছে দেখে যাই। এই সব চলতে থাকে আর আমার নিত্য কাজ চলতে থাকে। আজ আর কিছু করতে ইচ্ছা করছেনা। এক কাপ চা করে বসলাম। মেয়ে আসবে সেই রাত নয় টা। এখন আমার অখণ্ড অবসর। হঠাৎ ফোন টা বেজে উঠল। একটা অচেনা নম্বরের ফোন। ফোন টা ধরতেই ও প্রান্ত থেকে ভেসে এল এক পুরুষ কন্ঠ, "হ্যালো রাণী? আমি সি ই ও বাসুদেব দাস বলছি।" হাত টা কেপে উঠল, মেরুদন্ড দিয়ে একটা ঠাণ্ডা স্রোত নেমে এল। মনে হল যেন হাত থেকে ফোন টা এক্ষুনি পরে যাবে। "রাণী?" আজ প্রায় তিরিশ বছর পর আজ আবার সেই... "হ্যালো!" চমকে উঠে ঘোর ভাঙ্গল, " হ্যালো !" ও প্রান্তের বাসুদেব দাসের কন্ঠ ভেসে এল "হ্যালো! রাণী, আজ মি: চৌধুরীর ফাইলের সফ্টকপি টা পাঠানোর ছিল, ওটা তো ড্রাফ্ট হয়ে আছে।" বললাম "সরি রং নম্বর "। ফোন টা রেখে দিলাম। কিন্তু মনের মধ্যে শুরু হল অসম্ভব ঝড়। সব যেন উল্টে পাল্টে যাচ্ছে, আছড়ে পড়ছে, ভেঙ্গে যাচ্ছে মনের সব দরজা।
সুদেব দা। ভালো নাম বাসুদেব দাস। একই পাড়ায় ছিল আমাদের বাড়ি। আমাদের বাড়ির চারটে বাড়ি পর ছিল ওদের বাড়ি। যখন আমাদের বাড়ি থেকে কোথাও যেতে হত ওদের বাড়ির সামনে দিয়ে যেতে হত। সেই কোলের বয়স থেকে আমাদের পরিচয়। একই স্কুলে পড়তাম। এক সাথে স্কুলে যেতাম। সে ছিল আমার থেকে দুই বছরের বড়। কিন্তু সেই পার্থক্য কোনো দিন বুঝতে পারিনি। সে ছিল আমার খেলার সাথী, দুঃখ সুখের অঙ্গীকার। আমার কিছু হলে সবার আগে তাকেই জানাতাম। আর সেও তাই। লুকিয়ে আমার জন্য চকলেট নিয়ে আসত নিজে না খেয়ে। সব সময় চেষ্টা করত আমার মন ভালো রাখতে। কোনো দিন যদি আমি স্কুলে না যেতাম ঠিক বিকেলে বাড়ি আসত আমায় দেখতে। এক বাড়িতে কিছু আত্মীয় এসে যাওয়ায় সেই দিন স্কুলে যেতে পারিনি। সে ছিল খুব লাজুক। তার ওপর বাড়ি ভর্তি লোক। সে ঢুকতেও পারছে না। কি মনে হল আমি এগিয়ে গেলাম রাস্তার পাশের জানলার সামনে। ওমা! গিয়ে দেখি সে দাঁড়িয়ে আছে রাস্তায়। আমায় দেখে ছুটে এগিয়ে এল, "কিরে সব আপন জন কে পেয়ে আমায় ভুলেই গেলি? আমি যে এক ঘন্টা ধরে এখানে দাঁড়িয়ে আছি।" বলেই গাল ফুলিয়ে রাগ করে চলে গেল। দু'দিন লেগেছিল তার অভিমান ভাঙ্গতে। যদি আমার সামান্য জ্বর হলেও নিজের ঘরে সারা রাত না ঘুমিয়ে কাটাতো। অবশ্য এই পুরো ব্যাপার টা তার এক তরফা ছিল না। সমান এবং বিপরীত প্রতিক্রিয়া আমার দিক থেকেও ছিল। এক বার ওর বসন্ত রোগ হল। আমি নাওয়া খাওয়া ছেড়ে সারা দিন কেদেঁ বেড়াতাম। তার কাছে যাওয়ার চেষ্টা করতাম। কিন্তু দেখতে না পেয়ে সে কি কান্না আমার। কোথায় গেল সে সব দিন।
আজও মনে আছে এক দিন স্কুলে যাওয়ার সময় একটা চিঠি হাতে গুজে দিল। আর সেই চিঠি হাতে পেয়ে সেদিন যে স্কুলে কি পড়িয়েছিল কিছুই কানে ঢোকেনি। সেদিন স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে কোনো মতে সব সেরে চিঠিটা নিয়ে বসলাম। খুব ছোট্ট একটা চিঠি। তাতে সবুজ কালিতে লেখা ছিল "তুমি সবার কাছে মধুরীনা, কিন্তু আমার কাছে তুমি শুধু রাণী, আমার রাণী "। আজও যেন সেই চিঠিটা আমার চোখে ভাসে।
এই ভাবেই বড় হতে লাগলাম। পাড়া প্রতিবেশীদের নজর পড়তে লাগল আমাদের ওপর। রং চরিয়ে বাবা মায়ের কানে আসতে শুরু হল সব। এমনি তেও আমার বাড়ি কট্টর ব্রাহ্মন আর ওরা দাস তার ওপর অর্থনৈতিক দিক দিয়ে ওরা অনেক টাই কম ছিল আমাদের থেকে। সুতরাং মেয়ের সুরক্ষিত এবং সুখী রাখতে আমায় বেশ যত্ন করে সেখান থেকে সরিয়ে ফেলা হল। বাবার ছিল সরকারি বদলির চাকরি। তাই আমাকেও বোঝাতে অসুবিধা হল না। যেদিন ওখান থেকে চলে আসব তার আগের দিন বাড়িতে এল। হাসি মুখে বলল "ভালো তো নতুন জায়গায় কত নতুন বন্ধু পাবি। তখন সুদেব দা কে আর মনেই পড়বে না। যদি কখনও মনে পড়ে আমি সব সময় তোর জন্য থাকব। " কথা গুলো বলেই মাথা নিচু করে চুপচাপ চলে গেল আমায় কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই। আর বলতাম টাই বা কি? মনের ভিতরে এত কথা জমে তালগোল পাকিয়ে শক্ত হয়ে গলার সামনে জমাট হয়ে কান্নার আকার নিয়েছে যেন এক্ষুণি বাঁধ ভেঙ্গে বন্যার প্রবল স্রোতে ভেসে যাবে সব। সেই শেষ দেখা। চলে এলাম নতুন জায়গায়। আসার সয় সুদেব দা কে আর কোথাও খুজে পেলাম না। নতুন জায়গায় এসে বন্ধু প্রচুর পেলাম কিন্তু পেলাম না আমার সুদেব দা কে। দিন কাটতে লাগল, বছর কাটতে লাগল। এক দিন বিয়ে ঠিক হল। উচ্চ বিত্তশালী অমিতের সঙ্গে। খুব ধুম ধাম করে বিয়ে হল। হানিমুন গেলাম সুইজারল্যান্ড। তখন আমি আর ও যেন একাত্মা। কিন্তু কিছু দিন পর থেকে বুঝতে পারলাম ওর চাই টাকা। অনেক টাকা, শুধু টাকা। আমার কষ্ট, আমার দুঃখ, আমার চোখের জল ওর চোখে পড়ে না। আমি একা হতে শুরু করলাম। বছর দেড়েকের মাথায় রোশনী হল, আমাদের মেয়ে। আমার নিঃসঙ্গ জীবনে আমার একমাত্র সঙ্গী। ভুলেই গেলাম সব। ভালোই তো ছিল ভুলে গিয়ে। আজ তাহলে কেন আবার সব মনের খনি থেকে উঠে এল। যা কবরের নিচে থাকা শক্ত পেরেকের কফিনের ভিতরে ঘুমিয়ে থাকে তা হঠাৎ জেগে উঠলে তা হয় অত্যন্ত ভয়ংকর। আমার মনের খুধার্ত বাঘ যেন জেগে উঠেছে। মোবাইল টা হাতে তুলে নিলাম। করব কি একটা কল? একটাই তো কল। যদি আবার ফিরে পাই হারিয়ে যাওয়া সুদেব দা কে। কিন্তু শুধু একটা নাম শুনেই এতটা এগোনো উচিৎ নয়। আর যদি সে আমার সুদেব দা না হয় তাহলে লজ্জায় পড়ে যাব। আর যদিও বা হয় তাতেই বা লাভ কি? আজ হয়তো তারও স্ত্রী সন্তান আছে। তার একটা সুখী সংসার আছে। হয়ত আমায় আর মনেই নেই। তার চেয়ে বরং এই ভালো। মনের ঝড় থেমে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। চোখের ধারে বন্যার জল বাঁধ ভাঙ্গছে। কখন যেন বাইরে বৃষ্টি নেমেছে সাথে হাওয়া। মেয়ে টা এখনো ফিরল না। অমিত এখন কোথায় কে জানে। দেখি দুজন কেই ফোন করি। মোবাইল টা তুলে চালু করে ফোন বাটন টা টিপতেই জলজল করছে ওই নম্বর টা। নাহ্ অমিত কেই আগে ফোন করি...