Sunday, 7 June 2020

যুযুৎসু

মহাভারতের অজানা চরিত্র যুযুৎসু

মহাভারত বিষয়ে আমরা অনেক কিছু জানলেও অনেক চরিত্র এখনো অনেকের অজ্ঞাত। কথায় আছে যা নেই মহাভারতে তা নেই ভূ-ভারতে। কি বিচিত্র এই মহাকাব‍্য।
মহারাজা শান্তনুর প্রথম স্ত্রী ছিলেন গঙ্গা। তিনি একে একে তার নয় পুত্রকে গঙ্গায় বিসর্জন ন্নন্নন্ত দশম পুত্র ভীষ্মের সময় মহারাজ শান্তনু দ্বারা বাধা প্রাপ্ত ঘটলে পুত্র ভীষ্মকে তার কাছে রেখে গঙ্গা নদীর জলে নিমজ্জিত হন। এর কিছুকাল পরে ধীবর কন্যা সত‍্যবতীকে দেখে রাজা শান্তনুর পুনরায় প্রেমরস জাগ্রত হয়। রাজা এগিয়ে গিয়ে তাকে প্রেম নিবেদন করেন এবং বিবাহের প্রস্তাব দেন। কিন্তু সত‍্যবতী তার প্রস্তাব গ্রহনের পূর্বে মহারাজা শান্তনুর কাছে কিছু শর্ত প্রদান করেন। প্রথমতঃ তাকে মহারানির স্থান দিতে হবে তার রাজসভায়। দ্বিতীয়ত তার পুত্ররাই হবে সান্তুনু পরবর্তী রাজা। ভীষ্ম নয়। এতে শান্তনু প্রচন্ড বিচলিত হয়ে পড়লে ভীষ্ম প্রতিজ্ঞা করেন তিনি কোনো দিন রাজা হবেন না। মহারাজা শান্তনু ও সত‍্যবতীর নতুন জীবনের সূচনা ঘটে। তাদের দুই পুত্র যথা চিত্রাঙ্গদ ও বিচিত্রবীর্য। চিত্রাঙ্গদ অকালে প্রাণ ত‍্যাগ করলে বিচিত্রবীর্যকে রাজা নির্বাচন করা হয়। বিচিত্রবীর্যের দুই স্ত্রী, অম্বিকা ও অম্বালিকা। কিন্তু বিচিত্রবীর্য অপুত্রক মারা গেলে তার  মা সত‍্যবতী তার প্রথম পক্ষের পুত্র ব‍্যাসদেবের সরনাপন্ন হন। ব‍্যাসদেব রাজপুরে এলে সত‍্যবতী তার কাছে অনুরোধ করেন বংশ রক্ষা করতে। মাতার অনুরোধে রাজি হলে প্রথমে অম্বিকা আসেন ব‍্যাসদেবের নিকট। কিন্তু মুনি ব‍্যাসদেবের তেজের সামনে তার চোখ বন্ধ হয়ে যায়। এরপর আসেন অম্বালিকা। তিনি বেদব‍্যাসকে দেখে ভয়ে পান্ডুর বর্ণ হয়ে যান। এরপর যথাসময়ে পুত্ররা জন্ম নিলে দেখা যায় অম্বিকার কর্ম ফলে তার পুত্র জন্মান্ধ আর অম্বালিকার পুত্র জন্ম অসুস্থ। এই শুনে সত‍্যবতী আবার অনুরোধ করেন ব‍্যাসদেবের কাছে পুনরায় অম্বিকার সঙ্গে মিলনের। কিন্তু অম্বিকা পূর্ব অভিজ্ঞতায় ভীত হয়ে কক্ষে তার  স্থানে তার এক দাশীকে প্রেরন করেন। কিন্তু দাশীর ব‍্যাসদেবকে দেখে কোনো ভীতির সঞ্চার ঘটল না। যথা সময় তার সন্তান জন্মালে তার নাম রাখা হয় বিদুর। এইভাবে বিচিত্রবীর্য ও অম্বিকার পুত্র হলেন ধৃতরাষ্ট্র এবং বিচিত্রবীর্য ও অম্বালিকার পুত্র হলেন পান্ডু। কিন্তু নিয়তির ফেরে ধৃতরাষ্ট্র ছিলেন জন্ম অন্ধ। কিন্তু রাজ সিংহাসনের নিয়মানুযায়ী কোনো শারীরিক অক্ষম ব‍্যাক্তি সিংহাসনের অধিষ্ঠান লাভ করতে পারেন না। তাই বয়ঃকনিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও পান্ডু হন ঘোষিত রাজা। কিন্তু ঋষি কিমিন্দম দ্বারা অভিশাপ প্রাপ্ত হলে তার দুই স্ত্রী কুন্তী ও মাদ্রীকে নিয়ে তিনি বনবাসে যান। তখন ধৃতরাষ্ট্র সিংহাসনের দায়িত্বপ্রাপ্ত রাজা নির্বাচিত হলেন। এদিকে তার পত্নী গান্ধারী ছিলেন দীর্ঘদিন অপুত্রক। চিন্তিত হয়ে পড়লেন ধৃতরাষ্ট্র। যদি পান্ডু পুত্ররা তার পুত্র থেকে বয়ঃজ‍্যেষ্ঠ হয় তাহলে তারাই হবে সিংহাসনের অধিকারী, রাজা। তার রাজা হওয়ার অপূর্ণ স্বপ্ন অপূর্ণই থেকে যাবে। তাই তিনি গান্ধারীর প্রধান দাশী সৌগন্ধার সঙ্গে সঙ্গমে মিলিত হলেন। তাদের একটি পুত্র সন্তান জন্ম নিল। এই সন্তান কিন্তু ইতিহাসের পাতায় একটা প্রায় অজানা অধ‍্যায় হয়ে থেকে গেছে। সেই পুত্রের নাম ছিল যুযুৎসু। তিনি ছিলেন ন‍্যায় ও ধর্মের পৃষ্ঠপোষক। এরপর একে একে কৌরবের একশত ভ্রাতার জন্ম হল। কিন্তু তার আগেই কুন্তীর দূর্বাশা মুনির বরদানে একে একে জন্ম নেন ধর্মরাজ পুত্র যুধিষ্ঠির, পবনদেব পুত্র মহাশক্তিশালী ভীম,  মহারাজ ইন্দ্রের পুত্র অর্জুন এবং মাদ্রীর সন্তান অশ্বিনীকুমার দ্বয়ের পুত্র নকুল ও সহদেব। পান্ডুর পুত্র তাই এরা পান্ডব। পান্ডবরা ছিলেন ধর্ম এবং ন‍্যায়ের পরম পুজারী। অন‍্যদিকে কৌরব অর্থাৎ ধৃতরাষ্ট্রের পুত্ররা দূর্যধন, দুঃশাষন, বিকর্ণ সহ একশত ভ্রাতা সহ এক ভগিনী শান্তা। কৌরবরা ছিলেন ধর্ম ও ন‍্যায়ের বিপরীত পরিপন্থী। দুর্যধন গান্ধারীর পুত্র হলে রাজা ধৃতরাষ্ট্র দাশী পুত্র যুযুৎসুকে বিস্মৃত ঘটলেন। ন‍্যায়ের ও ধর্মের সাথে থাকার জন্য দুর্যধনের চক্ষুশূল। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের সময় তিনি ধর্মের প্রতি মনস্থির করলেন  এবং  অধর্মের সঙ্গ ছেড়ে যোগ দিলেন ন‍্যায়ের দলে। যুধিষ্ঠির যুযুৎসু সমন্ধে সব জানতেন। দাশী পুত্র হওয়া সত্ত্বেও তাকে তিনি ভ্রাতার সম্মান দিতেন এবং স্নেহ করতেন। কুরুক্ষেত্রের চোদ্দ দিন ব‍্যাপী মহাযুদ্ধ শেষে কৌরবরা যখন সব ভাই নিঃশেষ তখন একমাত্র কৌরব হিসেবে বেচে থাকলেন কেবলমাত্র যুযুৎসু। কিন্তু ইতিহাস তাকে সেই অর্থে মনে রাখেনি। তাকে সেই সম্মানও প্রদর্শন করেনি। তার ধর্ম ও ন‍্যায় নীতির জন্য তিনি যুদ্ধে বেচে গিয়েছিলেন। এরপর যখন পান্ডবরা রাজা হন এবং যথা সময়ে যখন সংসার ধর্ম ত‍্যাগ করে স্বর্গের পথে পাড়ি দিলেন তখন অর্জুনের পৌত্র পরিক্ষীত হলেন রাজা। আর তার রাজ‍্য শাষন দেখভালের জন‍্য নিযুক্ত করে গেলেন সেই যুযুৎসুকে।

Sunday, 17 May 2020

মৃত্যু যেখানে

মৃত্যু যেখানে 

কোডেক্স গিগাস বা শয়তানের বাইবেল। নাম টার সাথে আমরা কম বেশি সবাই পরিচিত। ত্রয়দশ শতাব্দীতে লেখা এই বইটি পৃথিবীর এখনো পযর্ন্ত সবচেয়ে বড় বই। তিন ফুট লম্বা কুড়ি ইঞ্চি চওড়া এবং প্রায় সাড়ে আট ইঞ্চি মোটা  সেই বই। বিজ্ঞানীরা বলেন যে কোনো ব‍্যাক্তি যদি দিনে চব্বিশ ঘন্টা কাজ করেন তাতেও বইতে যত ছবি এবং লেখা আছে তাতে প্রায় পাঁচ বছর কম করে লাগার কথা। কিন্তু গবেষণায় দেখা গেছে বইটা লেখা হয়েছে মাত্র কয়েক দিনে বা সপ্তাহে। জনশ্রুতি কোনো এক ব‍্যাক্তি মাত্র এক রাতে সমগ্র বইটি সম্পূর্ণ করেছিলেন। আর তার জন্য তিনি আশ্রয় নিয়েছিলেন এক শয়তানের। বইটি খুললেই দেখা যায় এক বিভৎস মূর্তি যা কথিত আছে বিশ্বের একমাত্র সত্যি শয়তানের ছবি যা নিজের হাতে তৈরি করেছিলেন শয়তান স্বয়ং। বাকি আমরা যে শয়তানের ছবি দেখতে পাই তা শুধুই শিল্পীর শিল্প কল্পনা।
যাই হোক, আমার এই শয়তানের বাইবেল নিয়ে কোনো মাথা ব‍্যাথা নেই। নেই কোনো উৎসাহ। কিন্তু আমার গল্পের যোসেফ কিন্তু এতে এতোটাই উৎসাহিত ছিল যে সেই বর্ণনাই হয়ে উঠেছিল রোমাঞ্চকর।

*********

ধরা যাক গল্পটার সময় কাল আজ থেকে দু'শো বছর আগের। স্থানটা ধরা যাক ইংল‍্যান্ডের কোনো এক গ্রাম।
যোসেফ ছিল এক খ্রিষ্টীয় যুবক। অবশ‍্য যুবক কিনা সেটা সঠিকভাবে ঠিক বোঝা যেত না। তার উচ্চতা ছিল খুব বেশি হলে আড়াই ফুট। কিন্তু কন্ঠস্বর যথেষ্ট ভাড়ি। তার বয়স সঠিকভাবে কেউ বলতে পারত না। কেউ বলত তিরিশ, কেউ বলত চল্লিশ আবার কেউ বলত পঁচিশ।  সবার কাছে সে ছিল হাসি মজার পাত্র। যখন সে স্কুলে যেত সব ছেলেরা ওকে ঘিরে ধরত আর নানা মজা টিটকিরি করত। একদিন সে স্কুল থেকে ফিরে ঠিক করল আর রাখবে না এই জীবন। শেষ করে দেবে সব। পাশের ঘরে থাকা মা কিছু একটা আন্দাজ করে ছুটে আসে ছেলের ঘরে। ছেলের ওই অবস্থা দেখে চিৎকার করে ওঠে সে। চিৎকারে হুস ফেরে যোসেফের। কাদতে কাদতে সে লুটিয়ে পড়ে মাটিতে। এদিকে মাও ছেলের কষ্ট দেখে আর স্থির থাকতে পারেনা। নিজেও কম কথা শোনেনা এরকম ছেলের জন্য। তাই ছেলের হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে গেল এক ব‍্যাক্তির কাছে। তারা ঘরে ঢুকে দেখল একটা অন্ধকারাচ্ছন্ন ঘর। ঘরের মাঝখানে একটা পাঁচ মুখি তারা আঁকা। আর ঠিক তার মাঝখানে জ্বলছে একটা মোমবাতি। যোসেফ কে দেখেই কাছে ডেকে নিলেন তিনি। নিজের পরিচয় দিলেন জ‍্যাক। শিখিয়ে দিলেন নানান শয়তানের উপাচার ও মন্ত্র। সাথে দিলেন একটা ছবি। শয়তানের নিজের ছবি। তবে সেটা ছিল হাতে আঁকা। মায়ের সাথে বাড়ি ফিরে আসে যোসেফ। সেই রাত থেকেই শুরু হয় তার শয়তান সাধনা। এর ঠিক মাস খানেক পর যোসেফ একদিন স্কুলে গেল। তাকে দেখেই স্কুলের ছেলেরা স্বভাবতই হাসতে লাগল, মজা করল নিজেদের মধ্যে যোসেফ কে নিয়ে। আর এর নেতৃত্বে ছিল হেনরি নামক একটি ছেলে। যোসেফ কিন্তু এবার এক বারও রাগল না, উল্টে মৃদু হাসল শুধু। বাড়ি এসে সাধনায় বসল সে। পরের দিন সকালে হেনরি কে পাওয়া গেল একটা ওক গাছের নিচে। দলা হয়ে পাকানো তার শরীর। কেউ যেন তার শরীর নিয়ে আছড়ে পিছড়ে হাড় সব গুড়ো করে শরীরটা দলা পাকিয়ে দিয়েছে। তার একটা চোখ যেন খুবলে নিয়েছে কেউ, একটা হাত ছিড়ে পাশে পড়ে আছে।
সাফল্য পেয়ে এরপর আরো উৎসাহিত হয়ে ওঠে যোসেফ। শুরু হয় তার জীবনের নতুন অধ‍্যায়। নতুন নতুন বই জোগাড় করে কালো বিদ‍্যার পড়াশুনা শুরু করে সে। এখন তাকে দেখে যারা হাসে বা মজা করে অথবা বাধা দেয় রাগে না সে আর। গোপনে খোঁজ নেয় তাদের। পর দিন তাদের পরিনতী হয় হেনরির মতন।
যোসেফের মা প্রথম দিকে ছেলেকে উৎসাহ দিলেও পরের দিকে মা বুঝতে পারে ছেলের এই সাধনা দিন দিন ছেলে কে আরও খারাপ পথে নিয়ে যাচ্ছে। বাধা দিতে যায় ছেলেকে। কিন্তু যোসেফ এতে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। মাকে প্রাণে মারল না সে। কিন্তু সে হয়ে গেল আজীবনের জন্য নির্বাক চলৎশক্তিহীন একটি মানুষ।
বিভিন্ন বই নিয়ে পড়াশোনা করতে করতে তার হাতে আসে এমন একটি বই যাতে সে প্রথম খোঁজ পায় কোডেক্স গিগাসের। তারপর থেকেই সে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে সেই বই পাওয়ার জন্য। সে বুঝতে পারে সেই বইতেই আছে তার শক্তি বাড়ানোর পদ্ধতি যাতে সে পৌছাতে পারে শয়তানের আরও কাছে। আছে তার অমরত্বের চাবিকাঠি।
তার বদ্ধমুল ধারণা হয় এই বই আছে জ‍্যাকের কাছে। সে ছুটে যায় জ‍্যাকের কাছে। গিয়ে সোজা বলে " আমায় শক্তির মন্ত্র দিন। অমরত্বের মন্ত্র দিন। "
জ‍্যাক অবাক হয়ে তাকায় যোসেফের দিকে " আমি অমরত্বের মন্ত্র জানিনা।"
যোসেফ বলে ওঠে " আপনি জানেন না, কিন্তু কোডেক্স গিগাস সেটা জানে। "
" কোডেক্স গিগাস? "
" হ‍‍্যাঁ। সেটা আপনার কাছে আছে আমি জানি।"
" সেটা আমি কোথায় পাবো?"
বাস্তবিক। কারণ কোডেক্স গিগাসের স্থান তো অন‍্যত্র। বেশ কিছুক্ষণ কথা কাটা কাটি চলে তাদের এই নিয়ে। এরপর প্রচন্ড রেগে বেড়িয়ে যায় যোসেফ। বাড়ি ফিরে সাধনায় বসে সে। আর তার সাধনার প্রভাব সাধারণ ভাবেই যায় জ‍্যাকের দিকে।
জ‍্যাকও যোসেফের ব‍্যাবহারে কিছু একটা আঁচ করেছিল। তাই সে তৈরি করে বিশ্রী দেখতে এক পুতুল।
যোসেফ এদিকে সাধনা চালিয়ে চলেছে। কিন্তু কিছুতেই যেন আজ ঠিক হচ্ছে না। যতবার তার সাধনার প্রভাব জ‍্যাকের দিকে যায় ততবারই যেন তা অসফল হয়। তখন রাত দুটো। হঠাৎ যোসেফ দেখতে পায় তার সামনে জ্বালানো মোমবাতি থেকে একটা সরু ধোয়ার কুন্ডলী নির্গত হচ্ছে। অবাক হয়ে দেখতে থাকে যোসেফ। ধীরে ধীরে ধোয়ার সেই ছোট্ট কুন্ডলী বড় হতে থাকে। সেই কুন্ডলী যেন তাকে গ্রাস করে নিল। দুর থেকে যেন কারো গলা ভেসে আসছে " তুই অমরত্ব চেয়েছিলি। তোকে অমরত্ব দিলাম। প্রতি একশ বছর অন্তর তুই ফিরে আসবি চলেও যাবি। কিন্তু যাওয়ার সময় নিয়ে যাবি চারটি মানুষের প্রাণ। মোট তিন বার হবে। তারপর তুই হবি অসীম শক্তিশালী, অমর। এখন আর কারো ক্ষতি করতে দেব না তোকে। তুই সেই দিনই সম্পূর্ণ ভাবে বিলীন হবি যেদিন তুই আগুনে জ্বলবি।"
পরের দিন সকালে দেখা গেল যোসেফের মৃত দেহ পড়ে আছে তার ঘরে। অন্যদিকে জ‍্যাকের তৈরি সেই পুতুলের একটা চোখ খুবলানো, একটা হাত ভাঙা। মুখে নিষ্ঠুর হাসি।

**********

**একশ বছর পর **

থমাস নামক এক জনৈক ব‍্যাক্তি এক দিন তার বাড়ির লাগোয়া কুঁয়ো পরিষ্কার করছিলেন। এমন সময় কুঁয়োর নিচের কাদা মাটির সঙ্গে উঠে এল একটা পুতুল। কাদা মাটি মাখা সেই পুতুলের একটা হাত ভাঙা। একটা চোখও খুবলানো। অবজ্ঞা ভরে আবার বর্জের মধ্যে রেখে ফেলে দিয়ে আসে দূরে।
পরদিন সকালে নিজের বাগানে গাছের পরিচর্চা করার সময় থমাস দেখতে পায় গাছের আড়ালে উঁকি দিচ্ছে সেই হাত ভাঙা পুতুলটা। এবার খুব অবাক হয় থমাস, সাথে কিছুটা ভয়ও পায় সে। পুতুলটার নিষ্ঠুর হাসি তাকে আরো ভীত করে। সে পুতুল টাকে হাতে নিয়ে বাড়ি থেকে দূরে ফেলে আসে। সেই রাতে প্রায় দুটো নাগাদ থমাস স্বপ্ন দেখে পুতুল টা যেন তার কাছে এসেছে। তার চেহারা যেন পরিবর্তন হতে শুরু করেছে। সেটা যেন ধীরে ধীরে একটা মানুষের রূপ নিচ্ছে সেটা। তার ক্রুঢ় হাসি মাখা মুখ টা যেন তাকে খুন করতে আসছে। ভীষণ ভয়ে জেগে ওঠে সে। চমকে পাশে তাকিয়ে দেখে একটা পুতুল উল্টো হয়ে পড়ে আছে তার বিছানার পাশে। হাতে নিয়ে দেখে সেই হাত ভাঙা পুতুল টা। পরদিন সকালে থমাসের দুমড়ান শরীর টা পাওয়া গেল কুঁয়োর পাশে, চোখ খুবলানো, হাত ভাঙা।
এর সপ্তাহ দুয়েক পর রোজী একদিন ঘর পরিষ্কার করছে। বাবা থমাসের অন্তেষ্টি ক্রিয়া কিছু দিন আগে শেষ হয়েছে। বাবাকে সদ‍্য হারিয়ে মন খুব খারাপ। বিছানার নিচ পরিষ্কার করতে গিয়ে রোজি দেখতে পায় একটা পুতুল পড়ে আছে সেখানে। বিশ্রী দেখতে সেই পুতুল তুলে রাখে রোজি। ভাবে যারা এসেছিল বাবাকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে তাদের মধ্যেই কোনো বাচ্চা বোধহয় ফেলে গেছে। কেউ খোঁজ করতে এলে তাকে দিয়ে দেবে। আবার কাজে মন দেয় রোজি। কিন্তু রোজির মনে হয় ঘরের মধ্যে যেন সে ছাড়াও আরও কেউ আছে। ভাই উইলিয়াম এখনো ফেরেনি ঘরে। আজ কাল যেন একটু চুপ হয়ে গেছে। তাহলে ঘরে কে? সে যেন তার গতিবিধি লক্ষ্য করে চলেছে।
সেই রাতে তখন প্রায় রাত দুটো। হঠাৎ রোজির ঘুমের মধ্যে একটা অস্বস্তি শুরু হয়। দেখে একটা বেটে খাটো লোক দাড়িয়ে আছে ঠিক যেখানে সেই পুতুল টা ছিল। লোকটা তার দিকে তাকিয়ে আছে এক দৃষ্টিতে, ঠোঁটে যেন একটা নিষ্ঠুর হাসি। ভয়ে চিৎকার করে ওঠে রোজি। চিৎকার শুনে পাশের ঘর থেকে ছুটে আসে উইলিয়াম। তাকে দেখে ভয়ে কাদতে থাকে রোজি। সব শুনে উইলিয়াম এগিয়ে যায় পুতুল টার দিকে। পুতুল তখন নিঃশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হাতে তুলে নেয় উইলিয়াম সেই বিশ্রী পুতুলটা। ফেলে দিয়ে আসে বাড়ির বাগানে। দিন কয়েক পর উইলিয়ামের এক বন্ধু ডেভিড আসে তাদের বাড়ি। ডেভিড শুধু উইলিয়ামের বন্ধু ছিল না। ছিল রোজির বাগদত্তা। অনেক্ষণ গল্প চলে তাদের। সন্ধ্যার পর ডেভিড ফিরতে চাইলে উইলিয়াম তাকে এগিয়ে দিতে যায়। বড় রাস্তায় যখন এসে পড়ে তারা হঠাৎ কেন যেন ভাবাবিষ্ট হয়ে পড়ে উইলিয়াম। হঠাৎ চোখের সামনে একটা কালো ধোয়ার আবরন সৃষ্টি হয়। তার মনে হয় সেই ধোয়া যেন তাকে ঘিরে ধরছে ক্রমশ। সে শক্ত করে চেপে ধরল ডেভিডের হাতটা। কখন যে একটা বড় গাড়ি এসে গেছে তাদের সামনে খেয়াল করেনি ওরা। গাড়ি টা ওদের ওপর দিয়ে চলে গেল। দুজনের শরীর দুটো দলা পাকিয়ে পড়ে থাকল রাস্তার ওপর। তাদের দুজনের দুটো হাত কাটা, চোখ দুটো যেন বেড়িয়ে আসছে কোটর থেকে।
ছোটবেলা থেকেই মা হারা রোজি। বাবা দুই ভাই বোন কে একাই মানুষ করেছে। সেই বাবা আর নেই। একমাসের মধ্যে ভাইকেও হারালো সে। যার সাথে জীবন বাধার স্বপ্ন দেখেছিল সেই ডেভিডও আজ আর বেচে নেই। গভীর হতাশা ঘিরে ধরে রোজিকে। একদিন রাতে তখন প্রায় দুটো। হঠাৎ ঘরে যেন কিছুর অস্তিত্ব টের পায় সে। বিছানা ছেড়ে উঠে বসে সে। পাশ ফিরতেই চমকে ওঠে রোজি। সেই হাত ভাঙা চোখ খোবলানো পুতুলটা। দাঁড়িয়ে আছে সেখানেই যেখানে রোজি ওটাকে রেখেছিল। কিন্তু এই পুতুল তো বাইরে ফেলে এসেছিল উইলিয়াম আর এতদিন তাকে কোথাও দেখতেও পায়নি সে।
দেখতে দেখতে পুতুল টার গা থেকে যেন ধোঁয়ার কুন্ডুলী বের হতে শুরু করে। রোজি খুব অবাক দৃষ্টিতে এগিয়ে যায় তার দিকে। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সেই দিকে। ধোঁয়ার কুন্ডলী যেন এগোতে শুরু করেছে। পিছু পিছু এগিয়ে যায় রোজি। ধোঁয়ার কুন্ডলীটা এতক্ষণে যেন ঘিরে ধরে তাকে। চলে আসে রোজি কুঁয়োর একদম ধারে। উঠে পড়ে কঁয়োর পাচিলে। হঠাৎ পিছন থেকে কেউ যেন ধাক্কা দেয় তাকে। চিৎকার করে কুঁয়োর ভিতর পড়ে যায় সে। এত রাতে চিৎকার শুনে প্রতিবেশিরা ছুটে এসে দেখে রোজি পড়ে আছে কুঁয়োর ভিতর। তাকে তুলে আনলে দেখা যায় সে মৃত। কুঁয়োর প্রাচীরের ধাক্কায় তার এক হাত ভেঙে গেছে। পাথরের উপর পড়ায় একটা চোখ তার উঠে এসেছে।

*******

** আরো একশ বছর পর **

স্মিথ আর তার পরিবার তাদের ছুটি কাটাতে গেছে এক সমুদ্র সৈকতে। এক দিন স্মিথের সাত বছরের ছেলে জন খেলতে খেলতে এসে যায় একদম সমুদ্রের জলের কাছে। হঠাৎ তার চোখে পরে কিছু একটা বালির ওপর চকচক করছে। এগিয়ে যায় সে। দেখে ছোট্ট একটা পুতুল। কিন্তু পুতুলটা কেমন যেন অদ্ভুত ধরনের দেখতে। তুলে নেয় সে হাতে। ভাইকে কিছু করতে দেখে এগিয়ে আসে তার দিদি কাইলি। দিদিকে দেখে উচ্ছসিত ভাই চিৎকার করে ওঠে " দেখ দিদি আমি এখানে একটা পুতুল পেয়েছি।" বলে দিদির হাতে দেয় সে পুতুল টা। এগারো বছরের দিদি কাইলি হাতে নেয় পুতুল টা। কিন্তু হাতে নিয়েই কেমন যেন অনুভূতি হয় তার। পুতুলের দিকে তাকাতেই চমকে ওঠে সে। সাধারণ একটা পুতুল। কিন্তু বিভৎস সেই পুতুলের চেহারা। তার ডান চোখ কেউ যেন খুবলে নিয়েছে। কালো হয়ে আছে জায়গা টা। আরেকটি চোখে ক্রূড় দৃষ্টি। মাথার দিক টা ভেঙ্গে গেছে কিছুটা। একটা হাত ভাঙা। মুখে একটা তীব্র নিষ্ঠুর হাসি। হাতে নিয়েই ভয়ে পুতুলটা ছুড়ে ফেলে দেয় সমুদ্রের জলে। হাত ধরে টেনে নিয়ে আসে  ভাইকে। ভাই আর কি করে, বেজার মুখে দিদির সাথে চলে আসে।
এর কিছুদিন পর তারা ফিরে আসে বাড়িতে। বাড়িতে ঢুকে নিজের ঘরে যায় জন। আর দরজা খুলতেই সে চমকে ওঠে। খুশিতে খেলে যায় তার ছোট্ট মন। তার নিজের বিছানার ওপর বসে হাসছে কুড়িয়ে পাওয়া সেই পুতুল টা। জন যেন পায় তার খেলার সঙ্গী, তার বন্ধু। খুব যত্নে  আদর সবার থেকে আড়াল করে রাখত সে পুতুল টাকে।
এর কিছুদিন পর রাত তখন প্রায় দুটো। হঠাৎ ঘুমের মধ্যে কেমন যেন অস্বস্তি হতে শুরু করে স্মিথের। ঘরে যেন কেউ একটা আছে। ঠিক তার বিছানার পাশেই যেন দাঁড়িয়ে আছে এক বিশালাকার মুর্তি। তার দিকেই যেন তাকিয়ে আছে আগুন চোখে। ভীষন ভয়ে উঠে বসে স্মিথ। চারদিকে তাকিয়ে দেখে সে। নাহ্ কোথাও কিছু নেই। স্ত্রী  এমিলি পাশে ঘুমিয়ে। নিছকই দুঃস্বপ্ন ভেবে স্মিথ একটু জল খেয়ে আবার শুয়ে পরে।
পরের দিন রাত দুটো। কাইলি ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখে সেই বিভৎস ভয়ংকর পুতুল টা যেন আবার ফিরে এসেছে তার কাছে। কাইলি যতই দূরে যাওয়ার চেষ্টা করছে ততই যেন পুতুল টা এগিয়ে আসছে তার কাছে।। আস্তে আস্তে যেন পুতুল টা মানুষে পরিনত হচ্ছে। যার উচ্চতা খুব বেশি হলে আড়াই ফুট। মুখে একটা হিংস্র ক্রুড় হাসি।
জন কিন্তু খুব খুশি। সে তার সাথে গল্প করে, খেলে। জন জেনেছে তার নাম যোসেফ। একদিন যোসেফ জন কে বলছিল " তোর দিদি টা খুব  খারাপ। আমায় কেমন জলে ফেলে দিয়ে ছিল। ওকে তো আমি.... " জনও তার কথায় সায় দেয়। " জানো যোসেফ কেউ জানেনা তুমি আমার বন্ধু। আমি তো কাউকে জানতে দেয়নি তুমি আমার কাছে আছো। যদি কেউ আবার ফেলে দেয় তোমায়।" ঠিক এই সময় কাইলি আসে ভাইয়ের গলা শুনে, কার সাথে কথা বলছে জন? ঘরে ঢুকেই প্রচন্ড ভয় পেয়ে যায় যোসেফ কে দেখে। চমকে উঠে চিৎকার করে ওঠে সে " কোথায় পেলি জন একে? একে তো আমি ফেলে দিয়েছিলাম সমুদ্রের জলে। " জন হাসে। এগিয়ে যায় দিদির দিকে। " জানিস দিদি আমি ওকে পাইনি। ও নিজেই এসেছে আমার কাছে, এই ঘরে। ও আমার বন্ধু। আয়না আয়। " "না। " চিৎকার করে কাইলি বলে " ফেলে দে। ওকে ফেলে  দে। " বলেই দৌড়ে সিঁড়ি দিয়ে নামতে যায়, কিন্তু হঠাৎ ওর মনে হল কেউ যেন ওকে পিছন থেকে ধাক্কা দিল। অনেক দিন পর বিছানা ছাড়তে পারেনি কাইলি। একটু সুস্থ হয়ে  উঠলেও কাইলির গলার স্বর আর ফিরে এল না। ফ‍্যাল ফ‍্যাল করে চেয়ে থাকে শুধু আর সেই পুতুল টার কথা মনে এলেই ভয়ে গুটিয়ে যায় সে।
স্মিথ কিন্তু যোসেফের উপস্থিতি ভালই অনুভব করত।
একদিন রাতে স্মিথ দেখে তার স্ত্রী এমিলি বিছানা ছেড়ে উঠে এগিয়ে চলেছে দরজার দিকে। মন্ত্রমুগ্ধের মত দরজা খুলে ফেলল সে। সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে গেল সে। চোখ স্থির। কেউ যেন তাকে দিয়ে সব করিয়ে চলেছে। এমিলি যেন আর নিজের বশে নেই। স্মিথ ডাকে " এমিলি "। কোনো উত্তর আসে না। এগিয়ে চলে সে। এবার স্মিথের কেমন যেন ভয় হতে শুরু করে। দৌড়ে গিয়ে টেনে ধরে এমিলির হাত। চেপে জড়িয়ে ধরে তাকে। এমিলি যেন জেগে উঠল। অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখে সে কিভাবে নিচে নেমে এসেছে। তার শুধু মনে আছে একটা ধোঁয়ার কুন্ডুলী তার দিকে এগিয়ে এসেছিল।
এই ঘটনার পর স্মিথ বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে সম্পূর্ণ ভাবে। একে মেয়ের এরকম অবস্থা। বাড়িতে সব সময় যেন একটা ভয়ের ভীতি। ঠিক করে পরিবার নিয়ে দূরে কোথাও ঘুরে আসবে। সেই মত একদিন সবাই তৈরি হয়ে রওনা দিল দূরের উদ‍‍্যেশ‍্যে। স্মিথ নিজের গাড়ি তার আগেই ঠিক করে রেখেছে যাতে রাস্তায় কোনো অসুবিধায় পড়তে না হয়।
বেশ চলছিল গাড়ি। ড্রাইভিং করছে সে নিজেই। সবার মন আজ খুশি। মুক্তির আনন্দে যেন ভেসে যাচ্ছে তারা। হঠাৎ স্মিথের কিছু একটা যেন হল। চোখের সামনে একটা ছোট্ট মানুষ যেন বা দিক থেকে ডান দিকে সরে গেল। গাড়ির ব্রেক টা চাপার চেষ্টা করল। কিন্তু কোনো লাভ হল না। লাভ হবে কি করে? তখন যে সেই হাত কাটা চোখ খোবলানো বিভৎস পুতুল টা ছোট্ট জনের ছোট্ট ব‍্যাগে বন্দি। তার বন্ধু, খেলার সাথী। তাকে রেখে কিভাবে জন একা যাবে বেড়াতে? তাই তা সঙ্গী যোসেফ। 
গাড়ি টা প্রবল বেগে ছুটে চলেছে। স্মিথের সামনে তখন ধোঁয়ার কুন্ডুলী। কিচ্ছু দেখতে পারছে না সে। পারছেনা সে থামাতে গাড়ি টা।গাড়ি টা সোজা গিয়ে ধাক্কা মারল একটা প্রকান্ড গাছের সাথে। সাথে গাড়ির এ‍্যক্সেলেটার ফেটে গিয়ে প্রচন্ড বিস্ফোরণ ঘটিয়ে সারা গাড়ি তে আগুন লেগে গেল। 
যোসেফ পেল আরো চারটি তাজা প্রাণ। আর মোটে একবার তাহলেই অসীম শক্তিশালী, অমর। কিন্তু যোসেফ ছোট্ট একটা ভুল করে ফেলল। অমরত্ব ও আরো শক্তিশালী হওয়ার আনন্দে সে ভুলে গিয়েছিল গুরুর কথা। সে তো বলেছিল আগুন লাগলে সে ধ্বংস হয়ে যাবে। আর সে যে ছিল সেই গাড়ির ভিতরে। 

Friday, 10 April 2020

মুক্তি

মুক্তি 
ভাবছিলাম কিছু একটা লিখি। কিন্তু কি লিখব কিছুই  মাথায় আসছে না। রাতে খাওয়া সেরে এক কাপ দুধ ছাড়া কালো কফি যাকে সাহেবি কায়দায় বলে black coffee নিয়ে বসলাম। হঠাৎ মনে এল আমার জীবনে ঘটে যাওয়া এক আশ্চর্য ঘটনা যার সাক্ষী আমি স্বয়ং। আজ বছর খানেক পরে সেটাই লিপিবদ্ধ করছি।

*******

আমি অমিত রায়। একটা পত্রিকার অফিসের এডিটর। লেখা লেখির অভ‍্যেস আছে। আর সেই কাজে দিন দুয়েক হল এই বাড়িতে এসেছি। এটা সুদীপ এর বাড়ি। সুদীপ আমার কলেজের বন্ধু। সুদীপের সাথে হঠাৎ সেদিন বাস স্টপেজে দেখা। প্রথম টায় ঠিক চিনতে পারিনি। ওই এগিয়ে এল। "আরে অমিত! তুই এখানে?" কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললাম " সুদীপ!"
" চিনতে পেরেছিস তাহলে? তারপর কি করছিস? কোথায় আছিস? " আরও কত প্রশ্ন করে গেল। আমিও প্রত্তুতরে সব বলে গেলাম। সেও আমায় সব বলল তার কথা। সে একটা প্রাইভেট অফিসে কাজ করত। এখন কি এক কারণে সেটা ছেড়ে নতুন কাজ দেখার চেষ্টায় আছে।
পুরোনো কলেজের বন্ধু পেলে যা হয়, গল্প তো আর শেষ হতেই চায়না। ইতিমধ্যে আমরা একটা কাফে তে বসেছিলাম গল্প করতে। কলেজের গল্প। বন্ধুদের গল্প। কে কি করছে এই নিয়ে কথা বলতে বলতে কখন ঘন্টা দুয়েক পেরিয়ে গেছে খেয়াল করিনি।
কথায় কথায় বললাম যে একটা নিরিবিলি জায়গা খুজছিলাম লেখালেখির জন্য। তো ও শুনেই আমায় বলল " তো চল না। আমার তো একটা বাড়ি আছে ঝাড়খন্ডে। দাদু কিনেছিল। বাবাও মাঝে মাঝে যেত ওই বাড়িতে। কিন্তু কোনো সময় বেশি দিন থাকেনি। আমি অবশ‍্য কোনো দিন যাইনি ওই বাড়িতে। বাড়ি টা বিক্রির কথা উঠছে। তাই ভাবছিলাম একটু ঘুরে আসি। হাতে তেমন কাজ নেই এখন। যাবি তো চল। কদিন নিরিবিলি তে কাটিয়ে আসা যাবে।
ঠিক হল চার দিন পর আমারা রওনা দেব। যাওয়া হবে আমার গাড়িতে। লম্বা রাস্তা। তাই গাড়িটাও সার্ভিসিং করিয়ে নিয়েছি। 
সকাল সকাল রওনা দিলাম দুই বন্ধুতে। পৌছাতে সেই সন্ধ্যা হয়ে যাবে। গাড়ি তে উঠেই মনটা ভালো হয়ে গেল। এতো দিন পর আবার বাড়ি ছেড়ে নতুনের উদ‍্যেশ‍্যে। 

******

ভেবেছিলাম রাত্রি আট টা নাগাদ পৌঁছে যাব। কিন্তু রাস্তায় একটা লরি ফেসে গিয়ে সব গাড়ি আটকে গিয়েছিল। ফলে প্রায় ঘন্টা দেড়েক লেট। যখন পৌছলাম তখন সাড়ে নয়টা বেজে গেছে।
বাড়ির সামনে এসে আমাদের গাড়ি থামল। অন্ধকারেও বাড়িটা দেখে মন ভরে গেল। একটা বেশ বড় দোতলা বাংলো ধরনের বাড়ি। ঢোকার মুখে ফটকের সামনে পুরোনো জরাজীর্ণ পাথরের এক রূপসী মহিলা আহ্বান জানাচ্ছে। ফটকের গায়ে সাদা পাথরের ওপর লেখা 'এডওয়ার্ড হাউস'। অবাক হয়ে সুদীপের দিকে তাকালাম। ও আমার মনের কথাটা বুঝেছিল বোধহয়। তাকানোর সাথে সাথেই বলে উঠল " কেভিন এডওয়ার্ড। দাদু এনার কাছ থেকেই এই বাড়িটা কিনেছিলেন। তখন মোটে দুটি ঘর ছিল। দাদু তারপর নিজেই পুরো বাড়িটা করেছে। ওই ঘর দুটো এখনো নাকি আছে।"
সামনের লন পেরিয়ে বাংলোর দরজার সামনে এসে দাড়ালাম। দরজা বাইরের দিকে আটকানো। সুদীপ ডাকল " রঘু, রঘু "। পেছনের একটিয়া একটা ঘর থেকে দরজা খোলার আওয়াজে ঘুরে তাকিয়ে দেখি এক শীর্ণকায় লোক বেরিয়ে এল। অন্ধকারে মুখ ঠিক বোঝা গেল না। সামনে এসে জিজ্ঞেস করল " বাবুরা এসেছেন? আপনাদের দেরি দেখে ভাবলাম আজ বুঝি আপনারা আর এলেন না। আসুন।" বলেই হাত থেকে ব‍্যাগ গুলো নিয়ে দরজার সামনে এগিয়ে গেল।
বাড়ির দিকে যত এগোতে লাগলাম মন টা কেমন বিষন্ন হয়ে আসছিল। কেন যেন মনে হচ্ছিল না এলেই বোধহয় ভালো হত।
দরজার তালা খুলে রঘু একটু চাপ দিতেই দরজা টা শব্দ করে জানান দিয়ে খুলে গেল। আর দরজা খুলতেই একটা বিশ্রী গুমট গরম হাওয়া গায়ে মুখে এসে ঝাপিয়ে পড়ল আর সাথে একটা চাপা গন্ধ। অনেক দিন কোনো ঘর বন্ধ থাকলে যেমনটা হয়। সুদীপ একটু যেন বিরক্ত হয়ে বলল " ঘর কি খোলা হয়না নাকি? এরকম অবস্থা!মুখ ঘুরিয়ে এক বার বিনয়ী হাসল রঘু। চাপা গলায় বলল " আপনারা কিছু দিন এখানে থাকুন বাবুরা নিজেরাই বুঝবেন।" হাত বাড়িয়ে সুইচ টিপতেই পুরো বাংলো টা যেন জেগে উঠল। আর কথা বাড়ালাম না। রঘু আমাদের একটা ঘরে নিয়ে এল।ব‍্যাগ গুলো রেখে বলল " এই ঘরে আজ রাতে থাকুন। পাশেই বাথরুম। আপনারা তৈরি হয়ে নিন আমি আপনাদের খাবার দিয়ে যাচ্ছি।"
আমরা আছি বাংলোর বড় ঘরটা অর্থাৎ যে ঘর দিয়ে আমরা ঢুকেছি তার ডান দিকের দরজা দিয়ে তিন নম্বর অর্থাৎ কোনার শেষ ঘরে। ওই বড় ঘরের বা পাশের দরজা দিয়ে গেলেও তিনটি ঘর যার মধ‍্যে দুটি ওই সাহেবের বানানো।
আমরা ফ্রেস হয়ে আসতেই রঘু আমাদের খাবার নিয়ে হাজির। রুটি আর দেশি মুরগির ঝোল।
থালা রেখে যাওয়ার সময় রঘু বলল " খাওয়া হয়ে গেলে বাসন গুলো দরজার বাইরে রেখে দেবেন। তাড়াতাড়ি শুয়ে পরুন। এত দুর এলেন।"
আমারাও খেয়ে নিয়ে থালা বাইরে রেখে হাত ধুয়ে সোজা বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লাম। সারাদিন গাড়ি চালিয়ে ক্লান্তিতে বিছানায় শোয়ার সাথে সাথেই ঘুমিয়ে পড়লাম।

********

তখন রাত কটা হবে ঠিক জানিনা। হঠাৎ কিছু একটা শব্দে ঘুমটা ভেঙ্গে গেল। ঘরের ছোট লাইট টা জ্বালিয়ে শুয়ে ছিলাম। সেটা নিভে গেছে। মোবাইলের আলো জ্বালালাম। কিন্তু পাশের খাটে সুদীপ নেই।
" সুদীপ, এই সুদীপ। " ডাকলাম আমি। কোনো সাড়া পেলাম না। দরজা টা খোলা।
বিছানা থেকে নেমে বাইরে বেরিয়ে দেখি সুদীপ কোথাও নেই। খুজতে খুজতে বড় ঘরটায় এলাম। বা দিকের দরজা টা খোলা। এগিয়ে যেতে দেখি সুদীপ দাড়িয়ে আছে একটা বন্ধ দরজার সামনে।
কেমন যেন ভয় লাগল। ডাকালাম " সুদীপ"।
 ঘুরে তাকাল আমার দিকে। ফেকাশে মুখ। ছোখ দুটো স্থির

********

পরের দিন ঘুম ভাঙল রঘুর ডাকে। উঠে ফ্রেস হয়ে চা খেয়ে ঠিক করলাম ওই ঘরেই আমরা যাব। বাড়ির বাকি সব ঘর শুধু ছিটকিনি দিয়ে আটকানো থাকলেও ওই পুরোনো ঘর দুটি তালা লাগানো। রঘুকে ডেকে সুদীপ বলল " রঘু ওই ঘর দুটো তালা লাগানো কেন থাকে? চাবিটা দাওতো একটু ঘুরে দেখি বাড়িটা।
" রঘু কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল " বাবু ওই ঘরে একটু অসুবিধা আছে। আপনারা নতুন লোক, দু'দিন বাদে চলেও যাবেন। তাই বলছিলাম ওই ঘর দুটো নাহয় বন্ধই থাক। "
" কেন? ওখানে কি অসুবিধা আছে? " জিজ্ঞেস করল সুদীপ। "
" আজ্ঞে বাবু বললে আপনারা বিশ্বাস করবেন না। আপনারা কলকাতার মানুষ এসবে আপনাদের মনে আসবে না। "
" ঠিক আছে তুমি বলনা শুনি। বিশ্বাস তো পরের কথা। " বললাম আমি।
একটু চুপ থেকে রঘু বলল " আসলে ওই ঘর দুটো খুব ভালো নয়। সন্ধ্যার পর থেকে ওই ঘর দুটো থেকে অদ্ভুত অদ্ভুত আওয়াজ আসে। যেন কেউ হেঁটে বেড়ায়। কথা বলে ফিসফিস করে। গোঙ্গানীর আওয়াজ পাওয়া যায় যেন কেউ তীব্র যন্ত্রণায় ছটফট করছে। দিনের বেলায় সব ঠিক থাকে। কিন্তু রাত হলেই.... আমি দিনের বেলায় ওই দিকের ঘর পরিষ্কার করি। এ বাড়ির সব কাজ বিকেলের আগেই সেরে রাখি। রাতে এদিকে আর আসিনা। " 
সুদীপ গম্ভীর হয়ে কথা গুলো শুনলো। তারপর শুধু বলল " চাবি টা দিয়ে যাও।"
রঘু চলে যেতেই সুদীপ আমায় বলল " জানিস অমিত কাল রাতে যখন ঘুমাচ্ছিলাম হঠাৎ আমার খাট টা দুলে উঠল। কেউ যেন খাট টা ধরে টানছে। ভয়ে আমি উঠে বসলাম। দেখি কেউ কোথাও নেই। তুই তোর খাটে শুয়ে আছিস। ভাবলাম মনের ভুল। শুয়ে পড়লাম। আবার শব্দ। এবার চোখ খুলে দেখি মানুষের মত একটা অবয়ব আমায় হাতছানি দিয়ে ডাকছে। তারপর আর কিছু মনে নেই। আবার ঘরে যখন এলাম তখন বুঝলাম কিছু হয়েছে। কিন্তু কি হয়েছে জানিনা।"
আমি হেসে বললাম " ঘুমের ঘোরে স্বপ্ন দেখে তুই ওরকম করেছিলি। কিচ্ছু না। চল ঘর গুলো দেখে আসি। "
" হম্। " বলল সুদীপ।

*******

চাবি দিয়ে তালা খুলে দরজাটা ঠেলতেই ক‍্যাঁচ করে খুলে গেল সেটা আর তার সাথে সাথেই এক রাশ ঘন অন্ধকার ঝাপিয়ে পড়ল আমাদের ওপর। মনে হল ঘরের ভিতর দুরের দেওয়ালের সামনে কেউ যেন দাঁড়িয়ে আছে আর সে যেন রক্ত মাংসের এক মানুষ, কিন্তু মুখটা রক্তহীন ফ‍্যাকাশে। আমরা নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে থাকতেই দেখি ওটা একটা বড় সাইজের ছবি। কিন্তু এতো জীবন্ত কোন ছবি কি কর হতে পারে? ঘরে ঢুকে জানালা গুলো খুলে দিলাম। ছবির সামনে গিয়ে দাড়ালাম। সার্টের ওপর ব্লেজার ও প‍্যান্ট পরিহীত এক মধ‍্য বয়স্ক ইংরেজ ভদ্রলোকের ছবি। মুখে দাড়ি। মোটা গোফ। চোখ দুটি নীলাভ। ছবির কিছু জায়গায় রং চটে গেছে। সুদীপ বলে উঠল " ইনি বোধহয় কেভিন এডওয়ার্ড। "
ঘরে আসবাব বলতে তেমন কিছু নেই। শুধু একটা হাতল ভাঙা চেয়ার আর একটা ভাঁজ করা কাপড় চেয়ারের ওপর। রঘু হয়ত পরিষ্কার করার জন‍্য রেখেছে।
সেই ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে এলাম পাশের ঘরে। এই ঘরে কিছু নেই। কিন্তু এক আশ্চর্য নিরবতা এই ঘর দুটি তে। সাথে গুমোট গরম আর চাপ চাপ অন্ধকার যা জানালা দিয়ে আসা আলোও যেন ভাঙতে পারছে না। সাথে একটা চাপা গন্ধ। কিন্তু গন্ধ টা খুব অস্বস্তিকর। ঘর দুটো যদিও রঘু ভালোই পরিষ্কার করে রেখেছে। আর একটা জিনিসও মনে হল, ঘর দুটোয় যেন কোনো চাপা বিষন্নতা ছেয়ে আছে।
ঘর থেকে ছবিটা সরিয়ে দাওনা কেন? আঁতকে উঠলো রঘু। কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বলল " সরিয়ে ছিলাম বাবু কয়েক বার। কিন্তু যত বার সরিয়েছি রাতে খারাপ খারাপ স্বপ্ন দেখেছি। অদ্ভুত অদ্ভুত কাজ হয়েছে বাড়িতে। তারপর থেকে আর সরাই না। "

********

রাতে কফি নিয়ে বসলাম লিখতে। মাঝের বড় ঘরে বসেছি। মাথায় কিছু আসছে না। কিছু তো লিখতেই হয়। মাত্র পাঁচ দিন ছুটি পেয়েছি। তার মধ্যে দুই দিন প্রায় শেষ।
ভাবছি কি লিখি। কখন যেন চোখ টা লেগে এসেছে। হঠাৎ কিসের একটা শব্দ হল। ঘরের বা দিকের পর্দা টা যেন নড়ে উঠল। সুদীপ তো ঘুমাচ্ছিল। কালকের ওই ঘটনার পর কেমন চুপ হয়ে গেছিল। আজ ওই ঘর দুটো দেখার পর পুরো চুপ হয়ে গেছে। সেভাবে কোনো কথাই হয়নি ওর সাথে।
কিন্তু একি! সুদীপ কোথায় যাচ্ছে এত রাতে? " এই সুদীপ, সুদীপ? " ডাকলাম আমি। ও যেন শুনতেই পেলনা ডাক। স্থির শূন্য দৃষ্টিতে ঘরের ডান দিকের দরজার দিকে এগিয়ে চলেছে। ভেজানো দরজা যেন নিজে থেকেই খুলে গেল। সুদীপ এগিয়ে চলেছে। যেন নিশীতে পেয়েছে। আমিও চললাম পিছনে পিছনে। গিয়ে দাড়াল বন্ধ ঘরের দরজার সামনে। ঘরের তালা টা আমরা বেরনোর সময় আটকে দিয়ে রঘু কে চাবি দিয়েছিলাম। কিন্তু এখন সেই তালা খোলা, দরজা টা শুধু ভেজানো। হালকা করে সুদীপ দরজায় ঠেলা দিতেই দরজা খুলে গেল। কিন্তু একি! অন্ধকারে কেউ যেন দাঁড়িয়ে আছে ব্লেজার, প‍্যান্ট পরে। রক্তহীন ফ‍্যাকাশে সাদা মুখ। মুখে একটা নিষ্ঠুর ক্রূঢ় হাসি। 

********

আমি যেন কোথায় হারিয়ে যাচ্ছি। আজ থেকে প্রায় বছর সত্তর পচাত্তর আগের  কিছু আবছা হয়ে আসা ছবি যেন ভেসে উঠলো চোখের সামনে । ঘরে যে চেয়ার টা দেখেছিলাম দিনের বেলায় সেই চেয়ারে বসে আছে দীপেন্দ্র বাবু। পাশের আরেকটি চেয়ারে কেভিন। তাদের সামনে টেবিলে রাখা মদের বোতল ও গ্লাস। দুজনেই নেশাতুর। হঠাৎ চেয়ার ছেড়ে উঠে  দাড়াল কেভিন। তুলে নিল একটা লম্বা কাপড়। পেচিয়ে ধরল দীপেন্দ্রর গলা। দীপেন্দ্রর মনে হল তার গলায় কেউ একটা কাপড় পেচিয়ে টানছে। মদের নেশা তখন এক ঝটকায় অনেক টা কেটে গেছে। এক টান দিয়ে কাপড় টা টেনে খুলে হেঁচকা টান দিতেই এডওয়ার্ড হুমড়ি খেয়ে পড়ল সামনে।
দীপেন্দ্র বাবু চিৎকার করে উঠলেন " বিশ্বাসঘাতক। তুই আমাকে মারার জন্য এখানে নিয়ে এলি? " বলেই হাতে ধরা মদের বোতল টি সজোরে বসিয়ে দিল মাথায়। মাথা থেকে ফিনকি দিয়ে রক্তপাত হতে শুরু করল এডওয়ার্ডের। কিছুক্ষণের মধ্যেই কেভিন লুটিয়ে পড়ল মৃত্যুর কোলে।
হঠাৎ আমার পাশে একটা সজোড়ে শব্দ হল। দেখলাম সুদীপ দৌড়ে গিয়ে "কেভিন... আমি... আমি মারতে চাইনি তোকে।" বলতে বলতে  চিৎকার করে সামনে গিয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল।

***********

সুদীপকে আর ওই বাড়িতে বেশিক্ষণ রাখা গেল না। জ্ঞান আসার পরই উঠে বসে বলল কলকাতা ফিরতে চায় সে। আর এক মুহূর্ত থাকবে না  সেখানে। চোখে মুখে একটা আতঙ্ক ছেয়ে রয়েছে ঘন মেঘের মতন। সেই দিনই দুপুরে চালিয়ে রওনা দিলাম কলকাতার পথে। রাস্তায় কোনো কথা বলেনি। শুধু নিষ্প্রান নিষ্পলক ভয়ার্ত দৃষ্টিতে চেয়ে থাকল সারা রাস্তা।
বাড়ি ফিরেও অনেক দিন অসুস্থ ছিল সুদীপ। একটা ট্রমার মধ্যে কেটেছে ওর অনেক দিন।

***********

এখনকার সুদীপ তখন ছিল দীপেন্দ্র নারায়ণ রায়। কেভিন এডওয়ার্ড ছিল তার প্রাণের বন্ধু। কেভিন কলকাতায় থাকাকালীনই পরিচয় হয় দীপেন্দ্র বাবুর সাথে। পরিচয় বন্ধুত্বের জায়গা নিল। হয়ে উঠল নতুন ব‍্যাবসার অংশীদার। দীপেন্দ্রর তখন এত প্রতিপত্তি ছিল না। আর কেভিন পরিবারবর্গ ত‍্যাগী অবিবাহিত যুবক। ব‍্যাবসার লাভের অঙ্ক ভালো আসতে শুরু করল। কেভিন ব‍্যাবসা বিস্তারের জন্য বিহারে যা আজ ঝাড়খন্ড যাতায়াত শুরু করল। সুবিধার জন্য সেখানেই একটা বাড়ি বানালো। নাম দিল 'এডওয়ার্ড হাউজ'। ভালোই দিন কাটছিল। এক দিন বন্ধু দীপেন্দ্রকে আমন্ত্রণ জানাল সে। এডওয়ার্ড কিন্তু তখন অন্য চিন্তায় নিমগ্ন। ব‍্যাবসার অংশীদার যদি না থাকে তাহলে পুরো লাভ‍্যাংশ তার। দীপেন্দ্র পৌছল এডওয়ার্ড হাউজে। কেভিন বন্ধুকে পেয়ে খুব খুশি। আদর আপ‍্যায়নের কোনো ত্রুটি রাখল না। রাতে খাওয়ার পর শুরু হল সুরা পান। এই চেয়ারে বসেই চলছিল তার মদ‍্যপান। মদের নেশায় ডুবে গেল দীপেন্দ্র। এডওয়ার্ড তখন নেশাতুর।
হঠাৎ চেয়ার ছেড়ে উঠে দীপেন্দ্রকে মারতে গেল কেভিন। কিন্তু নিয়তির খেলায় মরতে হল তাকেই।
ইংরেজ শাষন কাল। তার ওপর কেভিন সাহেব মানুষ। এই হত্যার কথা যদি সবাই জেনে যায় তাহলে তার কঠিন সাজা কেউ আটকাতে পারবে না। তাই তিনি ঘরের মেঝে খুঁড়ে সেখানেই তাকে কবরস্থ করলেন। সবাই জানল সাহেব ইংল‍্যান্ড পাড়ি দিয়েছেন ব‍্যাবসার কাজে।
এরপর বাড়ি টা দখল করে আরো ঘর বাড়ালেন দীপেন্দ্র। ততদিনে তার ব‍্যাবসা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। বাড়ির পুনঃনির্মান করলেন। ঘর বাড়ালেন। ওই ঘর দুটো কিছু করলেন না পাছে ধরা পড়ে যান। কিন্তু কোনো দিন ওই বাড়িতে তিনি থাকতে পারলেন না। এক রাতে তিনি ছিলেন। কিন্তু পর দিন সকালেই তাকে অসুস্থ অবস্থায় কলকাতায় নিয়ে আসা হয়। তিনি আর উঠতে পারেননি। এর কিছু দিন পরেই তিনি মারা যান।

বিঃদৃঃ সুদীপ তখনও অসুস্থ। সব সময় ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে থাকত। মাঝে মাঝে চিৎকার করে উঠত। ছাড়া ছাড়া কিছু ঘটনা বেড়িয়ে আসত তার মুখ থেকে। সেগুলো গুছিয়েই ঘটনা টা লিখলাম।

*********

এর বেশ কয়েক মাস পর আবার গেলাম সেই 'এডওয়ার্ড হাউজ ' এ। সাথে এবার গেল সুদীপের ভাই প্রদীপ। গিয়েই ছবির ঘরে গেলাম। মেঝে ভেঙ্গে ফেললাম। নিচ থেকে বেড়িয়ে এল প্রায় মিশে যাওয়া কঙ্কালের কিছু হাড়। স্থানীয় চার্চের সাথে যোগাযোগ করে তুলে দিলাম তাদের হাতে।

*********

কিছু দিন আগে সুদীপ এল আমার বাড়ি। এখন ও পুরো সুস্থ। জানালো এডওয়ার্ড হাউজ এখন সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। আর রঘুও আর কোনো অস্বাভাবিক কিছু অনুভব করে না। আর বাড়ি টাও খুব তাড়াতাড়ি বিক্রি হয়ে যাচ্ছে।


Saturday, 28 March 2020

একটি নিখুঁত দুর্ঘটনা


একটি  নিখুঁত দুর্ঘটনা 

তখন আমার আস্তানা ছিল এক জঙ্গলের ভিতর নদীর ধারের বাংলো। কুয়াশায় মোড়া এক অমাবস‍্যার রাত। চার দিক নিঃশব্দ। কোথাও কোনো লোকজন নেই। এই জায়গা টাই এরকম। দিন পনেরো মতো হয় ওখানে গিয়েছি। কোলকাতা টা বড্ড এক ঘেয়ে লাগছিল। আমার ছিল কাঠের ব‍্যাবসা। মুলত কাঠ যোগানোর চাহিদা আর নিজের এক ঘেয়েমী কাটাতেই সেখানে যাওয়া। ওখানে লোকজন কম থাকলেও কিছু দূরে আরেকটি বাড়ি ছিল। ভদ্রলোকের নাম নবীন বাগচী। তিনি ছিলেন সেখানকার জঙ্গলের দায়িত্ব প্রাপ্ত আধিকারিক। খুব ভালো লোক ছিলেন তিনি। তিনি আর তার স্ত্রী থাকেন। গাছ কাটার অনুমতি নিতে গিয়েছিলাম তার কাছে অফিসে। দুটির বেশি গাছ কাটার অনুমতি পাইনি। কিন্তু শর্তও ছিল । দুটো গাছ কাটলে চারটে চারা লাগাতে হবে। তাতেই রাজি। কিন্তু সেই সম্পর্ক পৌছল বাড়ি অবধি। তার স্ত্রীর সঙ্গেও আলাপ হয়েছিল। বেশ ভালো মহিলা। সহজেই মিশে গেছিল আমার সাথে।

********

রোজ রাতে খেয়ে উঠে একটু জঙ্গলে বেড়িয়ে আসা আমার অভ‍্যেস হয়ে উঠেছিল। সেই রাতেও বেরিয়েছিলাম একটু। এসে তৈরী বিছানায় শুয়ে আরাম করে ঘুম। ঘুম টাও হয়েছিল জোর। কাজের ছেলেটি মাধব এসে ডাকায় ঘুম টা ভাঙ্গল। সেই হাপাতে হাপাতে খবর দিল নদীর ধারে একটা লাশ পাওয়া গেছে। আর সেই লাশ নবীন বাগচীর। কিছুক্ষণ নিষ্পলক তাকিয়ে থাকলাম মাধবের দিকে যেন অন্য কোনো ভাষায় কথা গুলো বলল। সম্বিত ফিরে আসতেই এক লাফে উঠে জামা টা গায়ে চাপিয়ে ছুটলাম। গিয়ে দেখলাম পুলিশে ছেয়ে গেছে জায়গাটা। সবাইকে কাটিয়ে সামনে গিয়ে দেখি এক বিভৎস দৃশ্য। ভদ্রলোক রাতে বোধহয় এসেছিলেন নদীর ধারে কোনো কাজে। আর সেখানেই পা পিছলে পড়ে গিয়ে মাথাটা পুরো থেতলে গেছে। দাঁড়িয়ে থাকতে পারলাম না আর বেশিক্ষণ। বেরিয়ে এলাম। শুরু হল পুলিশী তদন্ত। আমি পারিবারিক বন্ধু বলে আমাকেও জিঙ্গাসা করল পুলিশ। যা জানি সবই বললাম। রাতে আমি বেরিয়েছিলাম এবং তার সাথে যে আমার দেখা হয়নি সে কথাও জানালাম পুলিশ কে। ঘরে ফিরে এলাম। বোধহয় অ‍্যাকসিডেন্ট কেস। হাঃ। মনটা খারাপ হয়ে গেল।

********

"এই দাদা দাদা শোননা। আমার বান্ধবী অমৃতা। ওকে একটু ওর বাড়ি দিয়ে আসবি? রাত হয়ে গেছে, একা যেতে ভয় পাচ্ছে। যা না দাদা একটু দিয়ে আয়।"
আমার বোন অন্তরার সেদিন ছিল জন্মদিন। ওর কয়েকজন বান্ধবী এসেছিল। সবাই চলে গেলেও ও কোনো একটা কাজে আটকে গেছিল। তাই রাত হয়ে গেছিল। অগত‍্যা অনিচ্ছা শর্তেও গেলাম। বাইকের পিছনে বসল অমৃতা। দুজন দুজনকে চিনি না। কোনো কথাও হল না দুজনের। বাইক থেকে নেমে লজ্জা অবনত মুখে সামনে এসে ধন্যবাদ জানিয়ে বাড়ির ভিতরে চলে গেল। কিন্তু কি যেন ছিল সেই সেই ধন্যবাদে। আমি কোনো দিন এসব নিয়ে ভাবিনি। ব‍্যাবসা নিয়েই থাকতাম। কিন্তু...
আস্তে আস্তে কখন যেন সেই পরিচয়  টা গভীর হয়ে ভালোবাসার সম্পর্কে দাড়ায়। চলছিল বেশ দিন গুলো।  বোনও জানত সব। খুশিও ছিল। কিন্তু হঠাৎ একদিন কাদো কাদো মুখে অমৃতা এসে বলল "বিয়ে করবে আমায়?"
এই কথাটার জন‍্য তখনই ঠিক প্রস্তুত ছিলাম না। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলাম মুখের দিকে। ধীরে ধীরে মাথা নিচু করে বলল "আমার বিয়ে ঠিক করেছে বাড়ি থেকে। কিন্তু তুমি যদি এখন রাজি থাকো তাহলে তোমার কথা বলতে পারি বাড়িতে।" কিন্তু আমি সেদিন রাজি হতে পারিনি। আমার মনে হচ্ছিলো নিজের ব‍্যাবসা দাড় করাতে আরও সময় লাগবে। কারো দায়িত্ব নাওয়া মুখের কথা নয়। চলে গিয়েছিল সেই দিন ও। আমিও আটকাতে পারিনি।
এক দিন দেখলাম দেখলাম বোন সেজে নিয়ে বেরোচ্ছে। সামনে এসে মুখ নিচু করে বলল আজ অমৃতার বিয়ে। তুই তো আর.... মুখে কিছু বললাম না। চুপচাপ ঘরে খিল দিলাম ।

******

এর বছর খানেক পর বোনের বিয়ে ঠিক হল। অমৃতা এসছে বোনের সঙ্গে দেখা করতে। আমি দোকান থেকে কোনো দরকারে বাড়ি এসেছিলাম। গলার আওয়াজ পেয়ে দরজার পাশে এসে দাড়ালাম। আড় চোখে দেখলাম ওকে। বোনের সাথে হাসছে গল্প করছে কিন্তু সেই উচ্ছলতাটা কোথায় যেন হারিয়ে গেছে।
রাতে খাওয়া সেরে বোন ঘরে এল। " জানিস দাদা আজ অমৃতা এসেছিল। ওরা এখন উড়িষ্যার কোনো এক বনের কাছে থাকে। ওর বর ওই বনের দায়িত্বপ্রাপ্ত আধিকারিক। ওর এখন সব আছে। কিন্তু কেন জানিনা ওকে একটু বিমর্ষ লাগল। সেই খুশি খুশি ভাবটা যেন কোথায় হারিয়ে গেছে।"
আমি ওর দিকে তাকালাম। বুকের মাঝে কেমন একটা চিনচিন করছে। হঠাৎ বোন নিজের থেকেই বলল " ওর বরের নাম নবীন বাগচী।"

********

ওখানে যাওয়ার পর নবীন বাগচীর সাথে পরিচয় হল। আর সেই পরিচয় যাতে ঘর অবধি পৌছায় তাই বেশি বেশি যাতায়াত শুরু করলাম। একদিন সত্যি আমায় আমন্ত্রণ জানাল তার বাড়িতে। গেলাম। স্ত্রী এল আপ‍্যায়ন জানাতে। সেই চেনা মুখ। সেই চেনা কন্ঠস্বর। শুধু হাসিটাই বদলেছে। প্রাণহীন নিস্তেজ হাসি। আমার তখন মুখ ভর্তি দাড়ির জঙ্গল। মোটা গোফ। বড় বড় চুল। মোটা রিমের কালো ফ্রেম। তখন আমায় চেনা বেশ শক্ত। চা নিয়ে সামনে এসে দাড়াল। চা টা যখন সামনের টেবিলে রাখতে এল দেখলাম মোটা কালশিটে দাগ হাতের পিছনে। আর নবীন বাবুর ওর ওপর তীক্ষ্ণ বিতৃষ্ণ নজর ছোখ এড়াল না। এরপর  রাতের দিকে মাঝে  মাঝেই ওই বাড়ির দিকে যেতাম আর শুনতে পেতাম নবীন বাবুর কর্কশ মদ‍্যপ চিৎকার আর তার স্ত্রীর আর্তনাদ  ই দিন রাতেই ঠিক করলাম একে রাখা যাবে না। রোজ রাতে নদীর ধারে বেড়াতে যেতাম। সেই রাতেও গিয়েছিলাম। কিন্তু দিনের বেলায় কিছু কাজ সেরে রেখেছিলাম। প্রথমে মাঝ রাতে নদীর ওপারে একটা গাছ কিছু টা কেটে রেখে এসেছিলাম। দিনের বেলা নবীন বাবু কে গিয়ে বললাম " রাতে চোরা শিকারীরা গাছ কাটছে নদীর ওপারে। আপনি  রাতে নিজেই একবার দেখুন তারপর নাহয় পুলিশকে খবর দেবেন। " এত তাড়াতাড়ি রাজী হবেন ভাবিনি। ফিরে এলাম নদীর কাছে যেখানে গাছ টা কেটে রেখেছিলাম তার উল্টো দিকে নদীর এপারে একটাই বড় পাথর। তার ওপরে বিছিয়ে দিলাম একটা দড়ির ফাঁদ। আর ওই পাথরের ওপর আরেকটি পাথর চাপিয়ে দিলাম। রাতে খাওয়া আগেই সেরে বেরিয়ে গেলাম। গিয়ে বসলাম পাথর টার পিছনে। কিছু পরেই দেখতে পেলাম নবীন বাবু আসছেন ।  কাছে আসতে মদের গন্ধ নাকে এল। এসে ঐ পাথরের উপর। আমিও সুযোগ বুঝে দড়িতে দিলাম এক টান। সাথে সাথে চিৎ হয়ে পড়ল পাথরের ওপর। আমি উপরের পাথরটা দিলাম মাথা লক্ষ্য করে ঠেলে। থেতলে গেল মাথাটা। পা থেকে দড়ি খুলে জলে পা টা নামিয়ে ঘরে ফিরে এলাম। পুলিশ এল। তদন্ত হল। দুর্ঘটনায় মৃত্যু।

********
আজ আমি বিবাহিত। আমার স্ত্রীর নাম? অমৃতা আজও জানে তার আগের স্বামী দুর্ঘটনায় মারা গেছে। আর বতর্মান স্বামী এখন তার সব। এখন সব সময় তার চেনা হাসি ঠোঁটে লেগে থাকে। আরও যেন উচ্ছল।


Sunday, 23 June 2019

সুদেব দা

মাঝে মাঝে পৃথিবী টা খুব একা লাগে। মনে হয় কেউ নেই, কিচ্ছু নেই। আমি একা কোনো নিরালা দ্বীপে বসে আছি। সেখানে শুধু আমি একা। কোনো মানুষ নেই। পাখিরাও যেন এই পথ মারাতে ভুলে গেছে।  আজ আমার স্বামী অতি ব্যস্ত সফল একজন মানুষ। রাতের বিছানা ছাড়া তাকে আর পাওয়া যায় না। আমার মেয়ে সম্প্রতি সে  কলেজে উঠেছে। তার আর সময় কোথায় মায়ের সঙ্গে দুটো কথা বলার। মুখ টা ভাল করে দেখতে বোধয় appointment  নিতে হবে। আর আছে tv  যে আমার  সময়ের সাথী। কি সব যেন দেখায় কার দুটো  তিনটে বিয়ে। কেউ কালো বলে সংসারে স্থান নেই। আরো কিসব। আর আছে প্রতি হিংসা। সেটা খুন হলেও কোনো অসুবিধা নেই। মানুষের মনে যে কি থাকে কে জানে। আর এই writer গুলোর মাথায় যে কি আছে!!
এখন সন্ধ্যা ৭টা। tv তে একটা  কালো মেয়ের গল্প দেখাচ্ছে, সে নাকি আবার গায়িকা। তাই নিয়ে বাড়িতে খুব অশান্তি। নায়কের নাকি গায়িকা তে ফাঁড়া। কি অবস্থা। যাক যা হচ্ছে দেখে যাই। এই সব চলতে থাকে আর আমার নিত্য কাজ চলতে থাকে। আজ আর কিছু করতে ইচ্ছা করছেনা। এক কাপ চা করে বসলাম। মেয়ে আসবে সেই রাত নয় টা। এখন আমার অখণ্ড অবসর। হঠাৎ ফোন টা বেজে উঠল। একটা অচেনা নম্বরের ফোন। ফোন টা ধরতেই ও প্রান্ত থেকে ভেসে এল এক পুরুষ কন্ঠ, "হ্যালো রাণী? আমি সি ই ও বাসুদেব দাস বলছি।" হাত টা কেপে উঠল, মেরুদন্ড দিয়ে একটা ঠাণ্ডা স্রোত নেমে এল। মনে হল যেন হাত থেকে ফোন টা এক্ষুনি পরে যাবে। "রাণী?" আজ প্রায় তিরিশ বছর পর আজ আবার সেই... "হ্যালো!" চমকে  উঠে  ঘোর ভাঙ্গল, " হ্যালো !" ও প্রান্তের বাসুদেব দাসের কন্ঠ  ভেসে এল "হ্যালো! রাণী, আজ মি: চৌধুরীর ফাইলের সফ্টকপি টা পাঠানোর ছিল, ওটা তো ড্রাফ্ট হয়ে আছে।" বললাম "সরি রং নম্বর "। ফোন টা রেখে দিলাম। কিন্তু মনের মধ্যে শুরু হল অসম্ভব ঝড়। সব যেন উল্টে পাল্টে যাচ্ছে, আছড়ে পড়ছে, ভেঙ্গে যাচ্ছে মনের সব দরজা।

সুদেব দা। ভালো নাম বাসুদেব দাস। একই পাড়ায় ছিল আমাদের বাড়ি। আমাদের বাড়ির চারটে বাড়ি পর ছিল ওদের বাড়ি। যখন আমাদের বাড়ি থেকে কোথাও যেতে হত ওদের বাড়ির সামনে দিয়ে যেতে হত। সেই  কোলের বয়স থেকে আমাদের পরিচয়। একই স্কুলে পড়তাম। এক সাথে স্কুলে যেতাম। সে ছিল আমার থেকে দুই বছরের বড়। কিন্তু সেই পার্থক্য কোনো দিন বুঝতে পারিনি। সে ছিল আমার খেলার সাথী, দুঃখ সুখের অঙ্গীকার। আমার কিছু হলে সবার আগে তাকেই জানাতাম। আর সেও তাই। লুকিয়ে আমার জন্য চকলেট নিয়ে আসত নিজে না খেয়ে। সব সময় চেষ্টা করত আমার মন ভালো রাখতে। কোনো দিন যদি আমি স্কুলে না যেতাম ঠিক বিকেলে বাড়ি আসত আমায় দেখতে। এক বাড়িতে কিছু আত্মীয় এসে যাওয়ায় সেই দিন স্কুলে যেতে পারিনি। সে ছিল খুব লাজুক। তার ওপর বাড়ি ভর্তি লোক। সে ঢুকতেও পারছে না। কি মনে হল আমি এগিয়ে গেলাম রাস্তার পাশের জানলার সামনে। ওমা! গিয়ে দেখি সে দাঁড়িয়ে আছে রাস্তায়। আমায় দেখে ছুটে এগিয়ে এল, "কিরে সব আপন জন কে পেয়ে আমায় ভুলেই গেলি? আমি যে এক ঘন্টা ধরে এখানে দাঁড়িয়ে আছি।" বলেই গাল ফুলিয়ে রাগ করে চলে গেল। দু'দিন লেগেছিল তার অভিমান ভাঙ্গতে। যদি আমার সামান্য জ্বর হলেও নিজের ঘরে সারা রাত না ঘুমিয়ে কাটাতো। অবশ্য এই পুরো ব্যাপার টা তার এক তরফা ছিল না। সমান এবং বিপরীত প্রতিক্রিয়া আমার দিক থেকেও ছিল। এক বার ওর বসন্ত রোগ হল। আমি নাওয়া খাওয়া ছেড়ে সারা দিন কেদেঁ বেড়াতাম। তার কাছে যাওয়ার চেষ্টা করতাম। কিন্তু দেখতে না পেয়ে সে কি কান্না আমার। কোথায় গেল সে সব দিন। 
আজও মনে আছে এক দিন স্কুলে যাওয়ার সময় একটা চিঠি হাতে গুজে দিল। আর সেই চিঠি হাতে পেয়ে সেদিন যে স্কুলে কি পড়িয়েছিল কিছুই কানে ঢোকেনি। সেদিন স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে কোনো মতে সব সেরে চিঠিটা নিয়ে বসলাম। খুব ছোট্ট একটা চিঠি। তাতে সবুজ কালিতে লেখা ছিল "তুমি সবার কাছে মধুরীনা, কিন্তু আমার কাছে তুমি শুধু রাণী, আমার রাণী "। আজও যেন সেই চিঠিটা আমার চোখে ভাসে।
এই ভাবেই বড় হতে লাগলাম। পাড়া প্রতিবেশীদের  নজর পড়তে লাগল আমাদের ওপর। রং চরিয়ে বাবা মায়ের কানে আসতে শুরু হল সব। এমনি তেও আমার বাড়ি কট্টর ব্রাহ্মন আর ওরা দাস তার ওপর অর্থনৈতিক দিক দিয়ে ওরা অনেক টাই কম ছিল আমাদের থেকে। সুতরাং মেয়ের সুরক্ষিত এবং সুখী রাখতে আমায় বেশ যত্ন করে সেখান থেকে সরিয়ে ফেলা হল। বাবার ছিল সরকারি বদলির চাকরি। তাই আমাকেও বোঝাতে অসুবিধা হল না। যেদিন ওখান থেকে চলে আসব তার আগের দিন বাড়িতে এল। হাসি মুখে বলল "ভালো তো নতুন জায়গায় কত নতুন বন্ধু পাবি। তখন সুদেব দা কে আর মনেই পড়বে না। যদি কখনও মনে পড়ে আমি সব সময় তোর জন্য থাকব। " কথা গুলো বলেই মাথা নিচু করে চুপচাপ চলে গেল আমায় কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই। আর বলতাম টাই বা কি? মনের ভিতরে এত কথা জমে তালগোল পাকিয়ে শক্ত হয়ে গলার সামনে জমাট হয়ে কান্নার আকার নিয়েছে যেন এক্ষুণি বাঁধ ভেঙ্গে বন্যার প্রবল স্রোতে ভেসে যাবে সব। সেই শেষ দেখা। চলে এলাম নতুন জায়গায়। আসার সয় সুদেব দা কে আর কোথাও খুজে পেলাম না। নতুন জায়গায় এসে বন্ধু  প্রচুর পেলাম  কিন্তু পেলাম না আমার সুদেব দা কে। দিন কাটতে লাগল, বছর কাটতে লাগল। এক দিন বিয়ে ঠিক হল। উচ্চ বিত্তশালী অমিতের সঙ্গে। খুব ধুম ধাম করে বিয়ে হল। হানিমুন গেলাম সুইজারল্যান্ড। তখন আমি আর ও যেন একাত্মা। কিন্তু কিছু দিন পর থেকে  বুঝতে পারলাম ওর চাই টাকা। অনেক টাকা, শুধু টাকা। আমার কষ্ট, আমার দুঃখ, আমার চোখের জল ওর চোখে পড়ে না। আমি একা হতে শুরু করলাম। বছর দেড়েকের মাথায় রোশনী হল, আমাদের মেয়ে। আমার নিঃসঙ্গ জীবনে আমার একমাত্র সঙ্গী। ভুলেই গেলাম সব। ভালোই তো ছিল ভুলে গিয়ে। আজ তাহলে কেন আবার সব মনের খনি থেকে উঠে এল। যা কবরের নিচে থাকা শক্ত পেরেকের কফিনের ভিতরে ঘুমিয়ে থাকে তা হঠাৎ জেগে উঠলে তা হয় অত্যন্ত ভয়ংকর। আমার মনের খুধার্ত বাঘ যেন জেগে উঠেছে। মোবাইল  টা হাতে তুলে নিলাম। করব কি একটা কল? একটাই তো কল। যদি আবার ফিরে পাই হারিয়ে যাওয়া সুদেব দা কে। কিন্তু শুধু একটা নাম শুনেই এতটা এগোনো উচিৎ নয়। আর যদি সে আমার সুদেব দা না হয় তাহলে লজ্জায় পড়ে যাব। আর যদিও বা হয় তাতেই বা লাভ কি? আজ হয়তো তারও স্ত্রী সন্তান আছে। তার একটা সুখী সংসার আছে। হয়ত আমায় আর মনেই নেই। তার চেয়ে বরং এই ভালো। মনের ঝড় থেমে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। চোখের ধারে বন্যার জল বাঁধ ভাঙ্গছে। কখন যেন বাইরে বৃষ্টি নেমেছে সাথে হাওয়া। মেয়ে টা এখনো ফিরল না। অমিত এখন কোথায় কে জানে। দেখি দুজন কেই ফোন করি। মোবাইল টা তুলে চালু করে ফোন বাটন টা টিপতেই জলজল করছে ওই নম্বর টা। নাহ্ অমিত কেই আগে ফোন করি...

Wednesday, 29 May 2019

আজও সেই তুমি

#একটি খোলা চিঠি

আজ 22march । ঠিক ১০ বছর আগে আজকের দিনে তুমি চলে গিয়েছিলে আমায় ছেড়ে । আর ঠিক ৩মাস পরেই ছিল আমাদের বিয়ে । যদিও তুমি চাওনি এই বিয়ে তোমার স্বল্প আযু জেনে ।কিছুটা আমার ইচ্ছে তেই তুমি রাজি হয়েছিলে এই বিয়েতে ।
যেদিন collage এ প্রথম দিন তোমায় দেখেছিলাম সেই দিন থেকে জানতাম তুমি এক কঠিন রোগের স্বীকার । তোমায় নিয়ে hospital যেতে যেতেই মনে হয়েছিল তুমি শুধু আমার । তারপর মন দেওয়া নেওয়া হল । বুঝতে পারলাম তুমি আমার জীবন । সবার আপত্তি তেও তোমায় বিয়ের সিদ্ধান্ত নিলাম। যদিও পরে সবাই আমার জোরের কাছে বিয়ে টা মেনে নিয়ে ছিল সেদিন । কিন্তু পাকা কথার সাত দিন পরই তোমায় পেলাম। খাটে । তবে সেটা ফুল সজ্জার খাট নয়, মৃত মানুষ বহনের খাট । তুমি আমার কাঁধে চড়ে শ্মশানে চিতার আগুনে ছাই হয়ে গেলে ।
আমার একাকী নিঃসঙ্গ জীবনে তোমার বন্ধু অঙ্কিতা তোমাকে হারানোর দুঃখ ভোলাতে সব সময় পাশে পাশে থাকত। জানিনা কবে যেন নিজের অজান্তেই আমি তার প্রতি দুর্বল হতে শুরু করেছিলাম । কিন্তু আস্তে আস্তে বুঝতে পারলাম সে আর আমার মন চায় না। চায় শুধু আমার অর্থ আর শরীর । দিন দিন তার চাহিদা বাড়তেই থাকল । রোজ নিত্য নতুন । এক দিন এক অগ্যত মুহূর্তে সে যেন আমায় আরও বেশি পাওয়ার চেষ্টা করল । মুহূর্তের আবেগে ভেসে গিয়ে আমার উর্ধ্ব ওষ্ঠ স্পর্শ করতে যাচ্ছিল তার নিম্ন ওষ্ঠ কে। আর ঠিক তখনই আমার সামনে ভেসে উঠল এক জোড়া রোগে ভোগা চোখ আর সদ্য স্নাত ফুলের পাপড়ির মত ভেজা ঠোঁট । আমি আর পারলাম না । ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলাম অঙ্কিতাকে। রাগে দুঃখে অপমানে ছুটে গেল আমার ব াইকের কাছে । ছিড়ে ফেলল বাইকের সিট কভার। সেই বাইক যে বাইকে তোমায় নিয়ে যেতাম তোমার মন ভাল করতে । কখনও গঙ্গার ঘাটে বা কোন ছোট দের খেলার মাঠে । তুমি চলে যাওয়ার পর অনেক বার ভেবেছিলাম বাইক টা বেচে দেব। পারিনি । বাইক টা চালালে মনে হত তুমি আমার সাথে আছ। কিন্তু আজ সেই বাইক টা এভাবে...  আর রাখিনি। তিন দিনের মধ্যে জলের দরে বেচে দিলাম । আর অঙ্কিতা?  সেই দিনই শেষ । আর কোন দিনও খোঁজ নেওয়ার ইচ্ছে হয়নি। ও কোন দিন খোঁজ নিয়েছে বলে জানিনা। এরপর দিন ছিল এক প্রকার। ভেবেছিলাম আর বিয়ে করবনা। কিন্তু মা এর চাপে বিয়ে করতে বাধ্য হলাম। ফুল সজ্জার রাতে শ্রীপর্ণা ঘরে এল। ভাবলাম ওকে সব বলেদি। কিন্তু তার আগেই ও আমার হাত দুটো টেনে নিল ওর হাতে । আমি চমকে উঠলাম । দুই হাত দিয়ে তুলে ধরলাম ওর মুখ । না কোন ভুল নেই এ আমার সদ্য বিবাহিত স্ত্রী শ্রীপর্ণা । কিন্তু ওর স্পর্শ ওর গন্ধ ঠিক যেন আমার হারিয়ে যাওয়া মাধুরী । তুমি সেই তুমি । আজ এক বছর হল আমাদের বিয়ে হয়েছে । আজ বিবাহ বার্ষিকী । কিন্তু আজও যখন ও আমার শয্যা সঙ্গিনী হয়ে আমার পাশে আসে, আমার দুই বাহুর নাগ পাশে ও ধরা দেয় আমি শুধু তোমাকেই পাই, আমার অধরা মাধুরীকে। আজও সেই তুমি শুধু আমার । আমার মাধুরী ।

Monday, 27 May 2019

ডোরেমন ও তার সত্য ঘটনা

আমরা cartoon দেখতে কম বেশি সবাই পছন্দ করি । আর সেই cartoon যদি হয় কোন সত্যি ঘটনা আধারিত তাহলে তার তাৎপর্য অনেক বৃদ্ধি পায় তা আর বলার প্রয়োজন পড়ে না।  ঠিক সেই রকমই একটি cartoon Doremon । Fujiko F. Fujio এর লেখা এই cartoon carecter টি পিছনে লুকিয়ে আছে এক অত্যন্ত হৃদয় গ্রাহী এক সত্যি ঘটনা । 
আসলে গল্প টি Doremon এর নয় । গল্প টি nobita নামক এক ছোট্ট ছেলের । সে ছিল একটু  দুর্বল প্রকৃতির এবং বুদ্ধি তেও তার সম বয়সি দের একটু কম। তাই তার বন্ধুরা তাকে সব সময় দূরে সরিয়ে রাখত। কখনও খেলতে নিত না । সে একটি মেয়েকেও পছন্দ করত। নাম ছিল Shizuka Ni na moto । কিন্তু Shizuka ও তার স্বভাবের জন্য তাকে কোন গুরুত্ব দিত না । ফলে Nobita হয়ে পড়েছিল খুব একা। আর তার এই একাকিত্ব থেকেই জন্ম নেয় তার কল্পনার। আর সেই কল্পনাই হল Doremon। তার কাছে Doremon ছিল ভবিষ্যৎ থেকে আসা একটি robot। মূলত তার সময় ২২ শতাব্দী । সেই হয়ে উঠেছিল তার এক মাত্র বন্ধু এবং পরম বন্ধু । ডাক্তারি ভাষায় এই রোগের নাম  Schizophrenia। Nobita Doremon এর থেকে নানা রকম নতুন নতুন gadgets পেত। আর সেই সব জিনিস তাকে নিয়ে যেত আরও কল্পনার জগতে ।সে তার বন্ধুদের সাথেও কথা বলত এই নিয়ে । কিন্তু কেউ তাকে কোন গুরুত্ব দিত না এই কথার। কিন্তু Nobitaর বয়স যখন ১৬ বছর তার বাবা মা তাকে নিয়ে যায় doctor এর কাছে । আর সেখানেই জানতে পারে যে Nobita Schizophrenia তে আক্রান্ত । তার অনেক দিন চিকিৎসা চলে এবং সে সম্পুর্ন সুস্থ হয়ে উঠে । এরপর তার বাবা মা তাকে বাড়িতে নিয়ে আসে । গল্প টা এখানেই শেষ হলে ভাল হত। কিন্তু না গল্প টা এখানেই শুরু । 
সে বাড়ি ফিরে বুঝতে পারে Nobita শুধু মাত্র তার কল্পনা । কিন্তু তার পরম প্রিয় বন্ধু কে হারিয়ে সে আরও নিঃসঙ্গ । Nobita সেই নিঃসঙ্গতা আর সহ্য করতে না পেরে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করে । কিন্তু বাবা মার দৃষ্টি পড়ে যাওয়ায় তখনি তাকে hospital নিয়ে আসা হয় । এদিকে সে যখন প্রায় সুস্থ তখন একদিন তা বন্ধুরা আসে তার সঙ্গে দেখা করতে । আসে তার বাবা মা। আসে Shizuka ও। সেও সবার সাথে বেশ খুশি মনে কথা বলে । এরপর একটা সময় সে সবাই কে চলে যেতে বলে।  সবাই ঘর থেকে বেরিয়ে গেলে বন্ধ দরজার ভিতর থেকে শোনা যায় গুলির শব্দ ।  ছুটে ভিতরে গিয়ে সবাই দেখে Nobitaর গুলি বিদ্ধ শরীর । এই ভাবেই শেষ হয়ে যায় Nobitaর জীবন। এবং তার সঙ্গে শেষ হয় তার কল্পনার বন্ধু Doremon এর কাহিনী । 
আর এই বেদনা দায়ক কাহিনী কে সম্মান জানাতে Fujiko F. Fujio তৈরি করেন Nobita নামক cartoon series টি।
* সংগ্রহ গত ।

যুযুৎসু

মহাভারতের অজানা চরিত্র যুযুৎসু মহাভারত বিষয়ে আমরা অনেক কিছু জানলেও অনেক চরিত্র এখনো অনেকের অজ্ঞাত। কথায় আছে যা নেই মহাভারতে তা নেই ভূ-ভার...